শিরোনাম
সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

উদ্ভাবনের নেশায় মেতেছে তারুণ্য

সাঈদুর রহমান রিমন

উদ্ভাবনের নেশায় মেতেছে তারুণ্য

এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। সারা দেশেই নীরবে ঘটে চলেছে অভাবনীয় বিপ্লব। উন্নয়ন-উৎপাদন, প্রযুক্তিতে দেশের ঈর্ষণীয় অগ্রগতির পাশাপাশি মেধাবী তরুণদের নতুন নতুন আবিষ্কার দেশকে নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে আরেক উচ্চতায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এমনকি লেখাপড়া না জানা তরুণদের অবাক করা সব উদ্ভাবনের প্রশংসা ইতিমধ্যে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। ভোলার এক খুদে বিজ্ঞানী রাজু তৈরি করেছে জ্বালানিবিহীন মোটরসাইকেল। শতভাগ পরিবেশবান্ধব এ মোটরসাইকেল চলতে কোনো জ্বালানি লাগে না, মাত্র ১২ টাকা খরচেই পাড়ি দেয় দেড়শ কিলোমিটার পথ। উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে গেছেন বগুড়ার যন্ত্রকৌশলী আমির হোসেন, তিনি প্রস্তুত করেছেন জ্বালানিবিহীন গাড়ি। মাত্র ২৫ টাকার কার্বন খরচ করেই আমির হোসেনের গাড়ি টানা আট ঘণ্টা চলতে পারে, বহন করতে পারে যাত্রী ও মালামাল। গাড়ির ক্ষেত্রে আরও ব্যতিক্রম উদ্ভাবন রয়েছে ফরিদপুরের স্বল্পশিক্ষিত দরিদ্র হাবিবুর রহমান ইমরানের। তিনি এমন এক গাড়ি প্রস্তুত করেছেন, যে গাড়ি জলে-স্থলে সমানভাবেই চলাচল করতে পারে। যশোর চৌগাছার মাদ্রাসাছাত্র ১৭ বছরের তরুণ আবদুল্লাহ আল ফাহিম খেলতে খেলতে রীতিমতো ড্রোন আবিষ্কার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এই খুদে বিজ্ঞানীর তৈরি করা আকাশযানটি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে উড়ে দূর আকাশে, দারুণ গতিতে। এভাবেই নিত্যনতুন আবিষ্কারের উল্লাসে মেতে উঠেছে বাংলার তারুণ্য। দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তিন ছাত্র ‘সোলার সাইকেল’ আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। দিনের বেলায় এটি সূর্যের আলোয় চার্জ হয়। যদি রাতে চালানো হয় তাহলে রাস্তায় অন্যান্য যানবাহনের হেডলাইটের আলোতেও এটি চার্জ হবে। ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এ সাইকেল প্রস্তুত করতে খরচ পড়ে মাত্র ১৩ হাজার টাকা। এসব ছাড়াও আছে আরও উদ্ভাবন, আরও অনেক আবিষ্কার। বিদ্যুৎ ছাড়াই বাল্ব (বাতি) জ্বালানো, হিমাগার স্থাপন, মোবাইল নিয়ন্ত্রিত হুইলচেয়ার বানানোর পাশাপাশি অভিনব সিকিউরিটি ডিভাইস আবিষ্কারের ক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন দেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা। এখন সরকারি সহায়তায় উদ্ভাবন-আবিষ্কারে নতুন নতুন দৃষ্টান্ত গড়ে ওঠার আশাতেই তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ।

জ্বালানিবিহীন গাড়ি, চলে জলে-স্থলেও : ফরিদপুরের শিবরামপুর এলাকার দরিদ্র শেখ হাসমত আলীর পুত্র হাবিবুর রহমান ইমরানের ইচ্ছার গল্প যেন কল্পনাকেও হার মানায়। স্বল্পশিক্ষিত ইমরান এমন এক গাড়ি তৈরি করেছেন- যা জলে-স্থলে সমানতালে চলতে পারে। ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা ব্যয়ে এক বছরের চেষ্টায় বানানো বোট অ্যান্ড কারটিতে ১৫ জন যাত্রী বসতে পারে। বিমানের আদলে তৈরি করা গাড়িটি পানিতে চলাবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাছ শিকারও করা যায়। তেল-গ্যাস ছাড়াই চলে, এমন গাড়ি তৈরি করেছেন বগুড়ার যন্ত্রকৌশলী আমির হোসেন। আধুনিক সুবিধাসহ পরিবেশবান্ধব এই গাড়ির কয়েকটি মডেল এখন বগুড়া ও সিলেট শহরে চলাচলও করছে। ২৫০ কেজি ওজনের প্রাইভেট কারটি পাঁচজন যাত্রী নিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে। প্রতি আট ঘণ্টা পর পর শুধু ২৫ টাকা দামের একটি কার্বন বদলাতে হয়। গাড়িটি তৈরিতে খরচ হয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।

এদিকে সিলিন্ডারে শুধু বাতাস ভরে চালানোর মতো মোটরসাইকেল উদ্ভাবন করেছেন হবিগঞ্জের তরুণ হাফেজ মো. নুরুজ্জামান। জ্বালানি তেল ছাড়াই শুধু হাইড্রোলিক গিয়ার বক্স প্রযুক্তির সিলিন্ডারে একবার বাতাস ভরলেই সাইকেলটি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। কাঠ, লোহা ও অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি এর অবকাঠামো দেখতে অবিকল পালসার মোটরসাইকেলের মতো। চট্টগ্রাম শ্যামলী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যয়নরত মো. নুরুজ্জামানের বাড়ি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি গ্রামে।

ড্রোন-ফ্লাইং বোটের ওড়াউড়ি : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করা সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিল তৈরি করেছেন পণ্যবাহী ড্রোন। একই বিভাগের শিক্ষার্থী মারুফ হোসেন রাহাত ও রবি কর্মকারের সহায়তায় নির্মিত এই ড্রোন সফলভাবে পরীক্ষাও করা হয়েছে। নাবিল জানিয়েছেন, তার তৈরি করা এই ড্রোন পরিচালিত হয় অ্যাপস-এর মাধ্যমে। শাবির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্র্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. জাফর ইকবালের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ আকাশযান তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। পুরো খরচই প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ব্যক্তিগতভাবে বহন করেছেন। নাবিল জানান, ড্রোনটি আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় পাহারা দিতে পারে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রত্যন্ত এলাকার দুর্গত মানুষের খোঁজ জানতে, জরুরি সাহায্য পৌঁছাতে ড্রোন হতে পারে বিশ্বস্ত মাধ্যম। এদিকে মাত্র ১৭ বছর বয়সের মাদ্রাসাছাত্র আবদুল্লাহ আল ফাহিমও একটি আকাশযান (ড্রোন) তৈরি করে হৈচৈ ফেলেছেন। এই খুদে বিজ্ঞানীর তৈরি করা আকাশযান রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে উড়ছে দূর আকাশে, আবার যখন তখন তা নামিয়েও আনা যাচ্ছে। চৌগাছা উপজেলার জগদীশপুর ইউনিয়নের স্বর্পরাজপুর গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম আবদুল্লাহ আল ফাহিমের। পিতা হাফিজুর রহমান পেশায় কৃষক আর মাতা নুরুন্নাহার গৃহিণী। দুই ভাই বোনের মধ্যে ফাহিম বড়। অর্থাভাবে তিল তিল করে প্রস্তুতকৃত ড্রোনটির নাম রাখা হয়েছে ফ্লাইং মেশিন। এর আগে বুয়েটের চার শিক্ষার্থীর যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে ফ্লাইং বোট। ফ্লাইং বোটটি পানিতে চলতে চলতেই আকাশপথে উড়ে যেতে সক্ষম।

আরও যত আবিষ্কার : নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় ইউনিট প্রতি মাত্র ২০ পয়সা খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন তরুণ উদ্ভাবক জালাল উদ্দিন। এ যন্ত্রে পরীক্ষামূলকভাবে ২৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনও করেছেন তিনি। বিদ্যুৎ যন্ত্র আবিষ্কারক জালাল উদ্দিনের বাড়ি উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামে। তিনি দাবি করেন, যন্ত্রটিতে বাইরের যে কোনো শক্তি জ্বালানি হিসেবে প্রথম কয়েক মিনিট ব্যবহার করতে হয়। এরপর রি-সাইকেল পদ্ধতিতে যন্ত্রটি ৪০ শতাংশ জ্বালানির জোগান নিয়ে শতভাগ বিদ্যুৎ সঞ্চালন করে থাকে। তার দাবি, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে এ যন্ত্র জাতীয় গ্রিডেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে। এদিকে রিচার্জেবল ব্যাটারিচালিত মোটরসাইকেল তৈরি করেছেন মুক্তাগাছার আবু বকর। যে কোনো টু স্ট্রোক মোটরসাইকেল মাত্র ১৮ হাজার টাকা ব্যয়েই ব্যাটারিচালিত মোটরসাইকেলে রূপান্তর করতে পারেন আবু বকর। জ্বালানি ছাড়া ইঞ্জিন আবিষ্কারের দাবি করেছেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার চান্দুলিয়া গ্রামের শরীফুল ইসলাম। তার উদ্ভাবিত ইঞ্জিনের সাহায্যে কোনো প্রকার জ্বালানি ছাড়াই দেশের মিল-কারখানা, যানবাহন এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পর্যন্ত পরিচালনা সম্ভব বলে দাবি করা হয়েছে। পাবনার আটঘরিয়া কলেজের সহকারী অধ্যাপক কৃষিবিদ জাফর সাদেক ও তার সহোদর বিশ্বব্যাংকের সাবেক কনসালট্যান্ট শৌখিন জ্যোতির্বিদ মো. আবদুল্লাহ সাদেক দেশের প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থা আমূল বদলে দেওয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। দুই ভাইয়ের উদ্ভাবিত ‘দোতলা কৃষি’ পদ্ধতি বাংলাদেশে চালু হলে কৃষিক্ষেত্রে বার্ষিক গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ফসল উৎপাদন সম্ভব বলেও দাবি করা হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এম মনজুর হোসেন আবিষ্কার করেছেন এমন এক প্রাকৃতিক হিমাগার, যেটি বিদ্যুৎ ছাড়াই চলবে। কৃষি উপকরণ দিয়ে ৩০০ টন ধারণ ক্ষমতার এ হিমাগার তৈরিতে মাত্র ১৪ লাখ টাকা ব্যয় হয় বলে জানা গেছে। প্রায় বিনা খরচে বিদ্যুৎ ছাড়াই বাতি জ্বালানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন কাপ্তাই জোনে দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর ৭ ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটালিয়নের প্রকৌশলীরা। তারা মাত্র ৩০ টাকা খরচ করে বিশেষ এক ধরনের ‘সোলার বোতল বাল্ব’ তৈরি করেছেন, যা বিদ্যুৎ ছাড়াই ৫৫ ওয়াট বাল্বের সমপরিমাণ আলো দেয়।

এ বাল্বের কার্যকারিতা কমপক্ষে পাঁচ বছর বলেও দাবি করা হয়েছে। বাড়িঘর কিংবা নির্দিষ্ট সীমানায় কারও পা পড়লেই অবিরাম বাজতে থাকবে আপনার মোবাইল ফোন। ফলে সতর্ক হওয়া যাবে, চোরকে পাকড়াও করা যাবে অনায়াসেই। এমনই একটি ডিভাইস উদ্ভাবন করেছেন রাজশাহীর কাপাসিয়ার বাসিন্দা আকুল হোসেন মিঠু। বাসাবাড়ি, অফিস, ব্যাংক, কারখানা, গুদামের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম অ্যাডভান্স সিকিউরিটি সিস্টেম ডিভাইসটি বাণিজ্যিকভাবে মাত্র তিন হাজার টাকাতেই বাজারে ছাড়া সম্ভব বলে দাবি করেছেন মিঠু। পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব টিন তৈরির বিস্ময়কর এক আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মুবারক আহমেদ খান। এই টিনের নাম দেওয়া হয়েছে জুটিন। বাংলাদেশের এই বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, জুটিন ১০০ বছর অনায়াসে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ের মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারে। একটি প্রাইভেট কোম্পানির আইসিটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জহিরুল ইসলাম পানি থেকে গ্যাস তৈরির অভিনব এক মেশিন তৈরি করেছেন। একই মেশিন গাড়িতে কিংবা কারখানায় ব্যবহার করে প্রায় অর্ধেক জ্বালানি খরচ সাশ্রয়ের পাশাপাশি কালো ধোঁয়া রোধ করা যায়। ‘ফায়ার ফাইটিং রোবট’ আবিষ্কার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন খোকসার কৃতীমুখ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র হুমায়েত আসিফ। আবিষ্কৃত রোবট আশপাশের কোথাও আগুন লাগলে মুহূর্তেই টের পাবে এবং কাছে পৌঁছে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পানি ছিটিয়ে আগুন নেভাতে সক্ষম হবে। লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা রোধে অটো সিগন্যাল ট্রান্সমিটার নামে একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন নাটোরের যুবক মনোয়ার হোসেন মিঠু। জনবল ছাড়াই স্বয়ংক্রিয় এই অটো সিগন্যাল ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ট্রেন আসার ৫ থেকে ৭ মিনিট আগেই লেভেল ক্রসিংয়ের বেরিয়ার স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওঠা-নামা করবে।

সর্বশেষ খবর