সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

আশঙ্কিত বা আতঙ্কিত নয়, সতর্কতা প্রয়োজন

অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু

করোনা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে মাথার মুকুট। ১৯৬০ সালে করোনা আবিষ্কৃত হওয়ার সময় মানুষের মাথার মুকুটের সাদৃশ্য হওয়ায় এর নাম দেওয়া হয়েছিল করোনা। কিন্তু এই করোনা এখন সারা বিশ্বে মূর্তিমান আতঙ্ক। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১৪৭টি দেশের ১৫৬৭৯৯ জন আক্রান্ত হয়েছে, ৫৮৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৭৫৯৩৭ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। অনেক দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে, সারা বিশ্বকে সর্বশক্তি দিয়ে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের বিরুদ্ধে রীতিমতো চিকিৎসাযুদ্ধে নামতে হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ, বিপর্যস্ত বা সীমিত করা হয়েছে। এই ভাইরাস সংক্রমণের এপিসেন্টার বা কেন্দ্রবিন্দু চীনের উহান প্রদেশ থেকে সরে গিয়ে ইউরোপে তার ভয়াল থাবা বিস্তার করেছে। সারা বিশ্ব আতঙ্কিত ও আশঙ্কিত। এ কথা সত্যি যে বাংলাদেশে আমাদের ১৭ কোটি মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনযাপন করছে। ১১ মার্চ  WHO এটিকে বৈশি^ক মহামারী হিসেবে চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারগুলোকে তাগিদ দিয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি কেস ধরা পড়েছে এবং বিদেশ থেকে আগত বেশ কিছু লোককে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে, বাংলাদেশে যে এর বিস্তার ঘটতে পারে না, তা নয়, কিন্তু ২০০৯ সালে চীনে একই ধরনের ভাইরাসে (SARS) মৃত্যুর হার ছিল ১০%, ২০১২ তে মধ্যপ্রাচ্যের MARS-G মৃত্যুর হার ছিল ৩৪.৩% কিন্তু বর্তমানে সংক্রমিত এই ঈড়ারফ-১৯ করোনাতে মৃত্যু হার ৩.৪%; তবে বয়সভেদে এর তারতম্য রয়েছে। কাজেই করোনায় আক্রান্ত হলেই যে তার মৃত্যু ঘটবে এমন আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। যে কোনো মহামারীর ৬টি পর্যায় বা ধাপ রয়েছে, বাংলাদেশ এর দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এখনো কোনো এলাকাতে কমিউনিটি আউটব্রেকের বা কোনো গ্রুপের মধ্যে ঘটেছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু বিদেশ থেকে আগত কিছু লোকের মধ্যে এটি ধরা পড়েছে। মহামারীর যে ৬টি পর্যায় রয়েছে, তার তৃতীয় বা ৪র্থ পর্যায়ে স্কুল, কলেজ বন্ধ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব এই ব্যবস্থাসমূহ নিতে হয়। এখন পর্যন্ত যে সব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, বাংলাদেশ এখনো সেই ধাপে আসেনি বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে জনমনে সুস্পষ্ট একধরনের ভীতি বিরাজ করছে। সরকার উচ্চ পর্যায়ের অ্যাডভাইজরি কমিটি, টেকনিক্যাল  কমিটি ও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে টেকনিক্যাল কমিটির পরামর্শ ক্রমে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত ২৩১৪ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে এবং ১৩৫৩টি আইসোলেশন বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিদেশ থেকে আগত সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ঘরে বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে এর বিস্তার ও সংক্রমণ প্রতিরোধ বা সীমিত করা যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে সে জন্য এই মুহূর্তে ব্যক্তি ও সামাজিক সচেতনতা এবং কঠোরভাবে হোম কোয়ারেন্টাইন প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। যে ব্যক্তি বিদেশ থেকে এসেছেন তাকে মনে রাখতে হবে যে, কোয়ারেন্টাইন তার নিজের জন্য, তার পরিবারের অন্যদের জন্য এবং সমাজের জন্যও অত্যাবশ্যক এবং এটি মেনে না চলা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। ১৪ দিন সমাজ ও পরিবার থেকে আলাদা থেকে তিনি অন্যকে সংক্রমণের এবং মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে পারেন। কাজেই এই মুহূর্তে মোটিভেশন ও যথাযথ আইনের কঠোর প্রয়োগ ও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সুপারভিশনই সময়োপযোগী। আসুন আমরা নিজে বাঁচি এবং অন্যকেও বাঁচাই। আতঙ্কিত নয়, সতর্ক হই। এই করোনার হাত থেকে পরিবার, দেশ ও জাতিকে রক্ষা করি। পরিশেষে, ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া (অন্তত ২০ সেকেন্ড), অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ না করা, আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা, কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা, হাঁচি, কাশির সময় বাহু//টিস্যু/কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখা, অসুস্থ পশু-পাখির সংস্পর্শ পরিহার করা, মাছ-মাংস ভালো করে রান্না করে খাওয়া ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ও অন্তত ৩০-৪০ মিনিট হাঁটা ও অন্য কোনো ধরনের ব্যায়াম করতে ভুলবেন না।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, নাক-কান-গলা বিভাগ,

মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর