মঙ্গলবার, ১৭ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা আতঙ্কে চিকিৎসা অবহেলায় মর্মান্তিক মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিলেন নাজমা। শরীরে তখন তার জ্বর। বাবা আমিন উল্লাহ পাশেই ছিলেন বসা। সকালে ডাক্তার-নার্সদের ডিউটি বদল হয়। নতুন নার্স আর ডাক্তার আসেন ওয়ার্ডে। তাদের একজন নাজমার বেডের কাছে গিয়ে অসুস্থতার কারণ জানতে চান। নাজমার বাবা আমিন উল্লাহ কথা বলেন নার্সদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মেয়ের জ্বর এবং ঠান্ডা। কদিন আগে কানাডা থেকে দেশে ফিরেছে নাজমা।’ ব্যস, এটুকুই। এর পরই হুলস্থুল কান্ড। একজন নার্স চিৎকার করে অন্যদের বলতে থাকেন, ‘এই রোগী কানাডা থেকে এসেছে! তার জ্বরও আছে!’ পুরো ওয়ার্ডে তখন বিশৃঙ্খলা। এখানেই শেষ নয়। নার্সরা ডাক্তারের কাছে গিয়েও চিৎকার করে বলতে থাকেন, নাজমা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। ওয়ার্ড থেকে পালান সব নার্স, ডাক্তার। অন্য রোগীরাও তাদের বেড ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। নাজমার কাছে আর কেউ আসেন না। এক ফাঁকে আইইডিসিআর থেকে প্রতিনিধি এসে নমুনা নিয়ে যান পরীক্ষার জন্য। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে একজন চিকিৎসক গ্লাভস ও মাস্ক পরে নাজমার কাছে যান। তার হাতে ছিল অ্যান্টিবায়োটিক ভরা একটি সিরিঞ্জ। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে পুশ করার কিছুক্ষণ পরই নাজমার মৃত্যু ঘটে। এরও কিছু সময় পর পরীক্ষার রিপোর্ট আসে। জানা যায়, নাজমার করোনাভাইরাস নেই। ঘটনাটি খোদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। ঘটেছে শনিবার। শুধু সন্দেহের কারণেই করোনাভাইরাসে কোনো চিকিৎসা পেলেন না নাজমা। বিনা চিকিৎসায় তার মৃত্যু হলো।

ডাক্তারদের ভাষায়, তিনি গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল জটিলতায় মারা গেছেন। আর পরিবারের দাবি, তিনি মারা গেছেন ডাক্তার-নার্সদের করোনাভাইরাস আতঙ্ক আর অবহেলায়।

নাজমা আমিন (২৪) কানাডার সাসকাচোয়ান প্রদেশের ইউনিভার্সিটি অব রেজিনের ¯œাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। ৯ মার্চ ঢাকায় ফিরে তিনি পেটব্যথার কথা জানান। পরিবারের সদস্যরা জানান, নাজমা খেতে পারছিলেন না। প্রতিবার খাওয়ার সময় তার বমি ভাব হয়েছে বা পেটে ভীষণ ব্যথা হয়েছে। ১৩ মার্চ রাতে অসহনীয় ব্যথা হওয়ায় তাকে নেওয়া হয় বাড়ির কাছে মোহাম্মদপুরের একটি হাসপাতালে। আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) বেড খালি আছে এমন কোনো হাসপাতাল খুঁজে পাচ্ছিলেন না জানিয়ে নাজমার বাবা আমিন উল্লাহ বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে বলা হয়, তাকে দ্রুত আইসিইউতে নেওয়া দরকার। তখন অনেক রাত।’ পরবর্তী সময়ে নাজমাকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি ওয়ার্ডে ভর্তি করে স্যালাইন, অক্সিজেন ও ওষুধ দেওয়া হলে তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। আমিন উল্লাহ বলেন, ‘তার ব্যথাও কিছুটা কমেছিল।’

জানা গেছে, ঢামেক হাসপাতালে করোনাভাইরাসের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেই। তাই হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স ওই রোগীর কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন। একজন ওয়ার্ডবয় বলেন, ‘সবাই যখন শুনল ওয়ার্ডে করোনাভাইরাস রোগী আছে, তখন সবাই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। আমিও সেখানেই ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমার জীবনের শেষ সময় চলে এসেছে। এই রোগী থেকে যদি আমি সংক্রমিত হই, আর আমি আমার পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত করি, তাহলে কী হবে!’ একজন নার্স বলেন, ‘দেখুন, প্রত্যেকের নিজের জীবনের ভয় আছে। সেই ভয় নার্সদেরও আছে।’

নাজমার তদারকির দায়িত্বে থাকা সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম জামাল বলেন, ‘যখন জানা গেল মেয়েটি কানাডা থেকে এসেছে, তখন ওয়ার্ডে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।’ তবে পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে যায় বলেও তিনি যোগ করেন।

ঢামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘কর্মীদের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেই। দীর্ঘ সময় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে থাকতে হবে এ বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘তার করোনাভাইরাস আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য আমাদের আইইডিসিআর থেকে প্রতিনিধিদের আসতে বলতে হয়েছে।’ তারা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে জরুরিৎ ভিত্তিতে এ কাজটি করেছেন বলেও তিনি জানান।

ডা. এ বি এম জামাল বলেন, ‘আমরা সন্দেহ করছি, তার অন্ত্রে ছিদ্র ছিল। অর্থাৎ তার অন্ত্রের কোথাও ফাটল ছিল। তাকে যখন ভর্তি করা হয়েছিল, তখন তার শরীর থেকে প্রচুর তরল বের হয়ে গেছে।’

এদিকে গতকাল একই ধরনের আতঙ্ক দেখা দেয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল)। হাসপাতালটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী আছেন এমন কথা ছড়িয়ে পড়লে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কাছে সহায়তা চেয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরব থেকে আসা এক ব্যক্তি তিন থেকে চার দিন আগে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হন। তার হাতে-পায়ে সমস্যা আছে। ওই সময় থেকেই তার জ্বর, হাঁচি-কাশি আছে। গতকাল সকালের দিকে হঠাৎই ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এ সময় তার সঙ্গে ওই ওয়ার্ডে থাকা রোগী, হাসপাতালের কর্মচারীসহ সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক নার্স বলেন, সকালে বিষয়টি আইইডিসিআরকে জানানো হয়। দুপুর পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কেউ না আসায় ওই ওয়ার্ডের রোগীরা সেখান থেকে চলে যেতে চান। পরে ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালের নতুন ভবনের একটি কক্ষে আইসোলেশনে পাঠানো হয়। সেখানে নার্স-চিকিৎসক কেউ যেতে চাইছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের জন্য মাস্কসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই।

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মোহা. আবদুল গনি ন্ডে মোল্যা বলেন, এক মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে ওই রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন থেকেই তিনি সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত। তার বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে আইইডিসিআরে যোগাযোগ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর