বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

প্রতিদিন ডেস্ক

জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

সেল্ফ আইসোলেশনে থাকা কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়ার পরই পাল্টে গেছে কানাডার পুরো দৃশ্যপট। নজিরবিহীন মমত্ববোধের এ বক্তব্যটি এখন বেশ আলোচিত হচ্ছে। সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবার পর্যন্ত কানাডার সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কানাডার প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা থেরেসা ট্যামের রবিবারের বক্তৃতাটাই যেন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে অস্থির করে দিল। করোনাভাইরাস নিয়ে ফেডারেল পর্যায়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, Our window to flatten the COVID-19 curve is narrow. তিনি বললেন, কানাডিয়ানদের এক্ষুনি পদক্ষেপ নিতে হবে, নইলে ভাইরাসের বিস্তৃতি রোধ কঠিন হয়ে পড়বে। তার বক্তৃতা ব্রেকিং নিউজ হয়ে যায় মিডিয়ায়। নাগরিকদের উদ্বেগ দানা বাঁধে। পুরো রাষ্ট্রই নড়েচড়ে বসে। ছুটির দিনেই বসে যায় মন্ত্রিপরিষদের জরুরি বৈঠক। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের আলোচনায় ছিল বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং জোরদার করা, চারটি প্রধান বিমানবন্দরে সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ওঠানামা সীমিত রাখা।

সোমবার সকালেও সেই আলোচনাই ছিল। অটোয়ায় সোমবার সকালে বৈঠকের পর বৈঠক। শলাপরামর্শ। জাতির উদ্দেশে নিজের বক্তব্যের আগে ট্রুডো চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতামত চান, থেরেসা ট্যামের সিদ্ধান্ত জানতে চান। নির্ধারিত সময়ের ৪০ মিনিট পর পোডিয়ামে এসে তিনি আমেরিকা, মেক্সিকো বাদে বিদেশি নাগরিকদের কানাডায় প্রবেশ নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন। আগের দিন, এমনকি সকালেও এতটা কঠোর পদক্ষেপ আলোচনায় ছিল না। তাহলে এই সিদ্ধান্ত কেন নিতে হলো? একজন সাংবাদিক তাকে এই প্রশ্ন করেছিলেন। ট্রুডো দ্বিধাহীনভাবে জানিয়েছেন, করোনা সংকটের শুরু থেকেই আমরা কানাডার বেস্টক্লাস চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবাকর্মী, বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাদের পরামর্শেই সোশ্যাল ডিসটেন্সের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা যখন বলেছেন, সোশ্যাল ডিসটেন্সের সঙ্গে বিদেশি প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। আমরা তা-ই করেছি। আমাদের কাছে কানাডিয়ানদের নিরাপত্তা এবং সুস্থতা হচ্ছে জরুরি এবং অগ্রাধিকার।

লকডাউন বা কানাডাকে বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে ট্রুডো ছিলেন না। প্রতিবারই তিনি বলেছেন, আমাদের বিশেষজ্ঞরা, চিকিৎসকরা যেটি বলবেন, কানাডিয়ানদের স্বার্থরক্ষায় আমি সেটিই করব। ধারণা করা হচ্ছে, চিকিৎসকদের বিশেষ করে থেরেসা ট্যামের জোরালো সুপারিশেই জাস্টিন ট্রুডো বিদেশিদের প্রবেশ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।

দেশের সংকটকালে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর দেওয়া বক্তব্যটি নিছক কোনো সরকারপ্রধানের ভাষণ নয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে সরকারপ্রধানের বক্তব্য যদি নাগরিকদের মনে আস্থা তৈরি না করে, ভরসা না জাগায়, তাহলে তিনি কীসের নেতা! ট্রুডোর বক্তৃতাটা কেবল একজন নেতার বক্তৃতাই ছিল না, এটি ছিল দুর্যোগকালে পরিবারের প্রধান অভিভাবকের বাকি সদস্যদের বুকে আগলে রাখার মতো ব্যাপার। এর আগের বক্তৃতায় তিনি নিজেকে কানাডিয়ানদের পরিবারের ‘এল্ডারলি মেম্বার’ হিসেবে দাবি করেছিলেন। সর্বশেষ বক্তৃতায় তিনি যেন নিজেকে সেই অভিভাবকের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলেন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে হিমশিম খাওয়া বিশ্ব পরিস্থিতি আতঙ্কিত নাগরিকদের সামনে তিনি দাঁড়িয়েছেন নির্ভরতার প্রতীক হয়ে। বলেছেন, সংকটের গোড়া থেকেই দেশের সেরা চিকিৎসক, বিজ্ঞানীদের পরামর্শের ভিত্তিতে প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছি। তোমাদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের আশ্বস্ত করতে চাই, পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রতিটি পদক্ষেপই আমরা নেব।

বিদেশিদের কানাডায় প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিমান, মেক্সিকো, আমেরিকার সঙ্গে যোগাযোগ স্বাভাবিক রেখেছেন। কানাডার খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সিংহভাগই আসে মেক্সিকো, আমেরিকা থেকে। সেই পণ্যের সরবরাহ যাতে বিঘিœত না হয় সেই ব্যবস্থা রেখেই বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখার সব ব্যবস্থাই তিনি করবেন।

কানাডার নাগরিকদের কথা ভাবতে গিয়ে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস বা ভ্রমণে থাকা নাগরিকদের কথা ভুলে যাননি। তিনি বলেন, আমি জানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত কিংবা ভ্রমণরত কানাডিয়ানদের নিয়ে তোমরা উদ্বিগ্ন। আমি তোমাদের কথা দিতে চাই, দেশের বাইরে থাকা একজন কানাডিয়ানও আমাদের সহযোগিতার বাইরে থাকবে না। তাদের বিমান পেতে, ঘরে ফিরে আসার খরচের জন্য যদি সহায়তা দিতে হয় সেটি আমি করব। ইতিমধ্যে সে জন্য বিশেষ সহায়তা প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশের বাইরে থাকা কানাডিয়ানদের উদ্দেশে তিনি উদ্ধাত্ত আহ্বান জানান, যারা দেশের বাইরে আছ, এখনই ঘরে ফিরে এসো। যারা মাত্র ফিরেছ, তোমরা ঘরে থাক। কেবল নিজেকেই সুস্থ রাখার জন্য না, আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে দরকারি জায়গায় সেবা এবং মনোযোগ দিতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে তোমরা ঘরে থাক।

ট্রুডো যখন এ কথাগুলো বলছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল বিদেশ বিভুঁইয়ে আটকেপড়া সন্তানের পিতা, সন্তানের মঙ্গল ভাবনায় উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। নইলে এমন সংকটকালে দেশের প্রধানমন্ত্রী কী না তাদের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ারও ঘোষণা দিচ্ছেন। নাগরিকদের তিনি ধমক দিচ্ছেন না, নির্দেশ দিচ্ছেন না, হুমকি দিচ্ছেন না। তিনি তাদের ঘরে থাকতে অনুপ্রাণিত করছেন। বলছেন, নিজেকে ঘরে রেখে তুমি শুধু তোমার সুস্থতাই নিশ্চিত করছ না, তোমার পরিবারের, তোমার চারপাশের মানুষগুলোর সুস্থতাই নিশ্চিত করছ। তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, ঘরে থাকার, সোশ্যাল ডিসটেন্সের মানে কিন্তু এই না যে কারও সঙ্গে কথাবার্তাই হবে না। টেলিফোনটা হাতে তুলে নাও, কথা বল, ইমেইল কর। আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তিই তো হচ্ছে পরস্পরের কাছে আসতে পারার ক্ষমতা, একে অপরের যত্ন নিতে পারার ক্ষমতা। দৈব দুর্বিপাকের সময় তো এটা আরও বেশি জরুরি। কাজেই তোমার বন্ধুদের ফোন কর, চেনাজানা মানুষদের ফোন কর। গ্রোসারি স্টোরে যাওয়ার সময় তোমার প্রতিবেশীর খোঁজ নাও, দেখ তার কিছু লাগবে কিনা। আর হ্যাঁ, তোমার নিজের জন্য প্রয়োজনের বেশি এখন কিনো না। আরেকটা কথা বলি, বিশেষ প্রয়োজনে যখনই বাইরে যাও ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা কর্মীটির কাছে গিয়ে তাকে একটা ধন্যবাদ দাও। তুমুল এই সংকটকালে দেশের ফ্রন্টলাইনের এই কর্মীরাই কিন্তু সমাজটাকে সচল রেখেছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাও।

জাস্টিন ট্রুডো তার বক্তৃতায় নিজের কিংবা তার সরকারের কোনো কৃতিত্ব দাবি করেননি। তিনি চিকিৎসকদের, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশংসা করেছেন, প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা থেরেসা ট্যামের নাম নিয়েই তাকে বাহবা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শেষে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরাও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা কেউই একটিবারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নাম উচ্চারণ করেননি, তিনি কী কী করছেন তার বিবরণ দেননি। প্রত্যেকেই স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা করেছেন। মন্ত্রীদের কথায় মনে হচ্ছিল কানাডার করোনাভাইরাসবিরোধী লড়াইয়ের মূল নেতাই বোধ হয় প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা থেরেসা ট্যাম।

সর্বশেষ খবর