বৃহস্পতিবার, ১৯ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় দেশে প্রথম মৃত্যু

মৃত ব্যক্তি বিদেশফেরতের সংস্পর্শে ছিলেন, নতুন চারজনসহ আক্রান্ত ১৪, বিদেশে মৃত্যু আরও এক বাংলাদেশির, কোয়ারেন্টাইনে চিকিৎসক বিচারপতি সচিবসহ তিন হাজার, টেস্ট কিটসহ সহায়তার আশ্বাসে চীনের চিঠি, সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার ঘোষণা এডিবির পাবে বাংলাদেশও

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনায় দেশে প্রথম মৃত্যু

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একজনের মৃত্যু হয়েছে। ৭০ বছর বয়সী এ ব্যক্তি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বিদেশফেরত একজন ভাইরাস আক্রান্ত আত্মীয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছিলেন। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও নতুন করে চারজনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে একজন নারী, তিনজন পুরুষ। একজন আগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে ছিলেন। আর বাকি তিনজন বিদেশ থেকে এসেছেন। তার মধ্যে দুজন এসেছেন ইতালি, একজন কুয়েত থেকে। সব মিলিয়ে দেশে গতকাল পর্যন্ত ১৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১৬ জন আইসোলেশনে আছেন। আর প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৪২ জন। হোম কোয়ারেন্টাইন তিন হাজার ছাড়িয়েছে। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ও নতুন আক্রান্তদের তথ্য জানান। এ সময় তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির আগে থেকেই ফুসফুসে সমস্যা ছিল। ছিল ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি জটিলতা। এ ছাড়া হৃদ্্যন্ত্রে একবার স্টেনটিংও হয়েছিল। সেই দিক থেকে তিনি উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন এবং আমরা তাকে হারিয়েছি। এসব কারণে আমরা বারবার বয়স্কদের বিশেষ নিরাপত্তার জন্য বলছি। আর তিনি বিদেশেও যাননি। বিদেশ থেকে আসা একজনের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাকে কবরে দাফন করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন আক্রান্ত হওয়া চারজনের প্রত্যেকেই অন্যান্য রোগের (কো-মরবিডিটি) কারণে ঝুঁকিতে রয়েছেন। নতুন আক্রান্তদের বয়স যথাক্রমে ৫০, ৪০, ৩০ ও ২০ বছর। তাদের মধ্যে একজনের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিক রয়েছে; আরেকজনের কিডনির সমস্যা রয়েছে এবং অন্য একজনের স্ট্রোকের ইতিহাস রয়েছে। তবে তাদের করোনার লক্ষণ-উপসর্গ মৃদু, কিন্তু তাদের প্রত্যেকে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছেন।’ অধ্যাপক সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্যান্য দেশও বলেছে, তাদেরই মৃত্যুঝুঁকি বেশি যাদের কো-মরবিডিটি বা অন্য রোগ রয়েছে এবং যারা বয়স্ক।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশফেরতরা কেউ তথ্য গোপন করবেন না। ভ্রমণের তথ্য গোপন করলে আপনাকে খুঁজে বের করা কঠিন হবে। দেশের ভালো আপনাকেই বুঝতে হবে। তাই নিজ দায়িত্বে তথ্য জানানোর পাশাপাশি নিজেরা হোম কোয়ারেন্টাইনে যাবেন।’ আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, ‘বিদেশফেরতদের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ঠিকানা সংগ্রহ করে হোম কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আমাদের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কেননা পাসপোর্টের ঠিকানায় অনেকেই বসবাস করেন না। আবার পাসপোর্টে ঠিকানা দেওয়া আছে, তবে অনেকে অন্য জায়গায় বাস করছেন। এতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪৯ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ৩৪১ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, করোনাভাইরাসের ফলে হওয়া কভিড-১৯ রোগটি মারাত্মক নয়। কিন্তু ভাইরাসটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখানে মৃত্যুঝুঁকি থাকে না। এ ক্ষেত্রে সচেতন হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এর আগে গত ৮ মার্চ যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরেক বাংলাদেশি বৃদ্ধ মৃত্যুবরণ করেন। তার  ছেলে  জানান, তার বাবা ইতালি থেকে লন্ডনে ফিরে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

পরীক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে ঢাকার বাইরেও : দেশে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ঢাকার বাইরে কয়েকটি স্থানে নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে কয়েকটি গবেষণাগারে এ পরীক্ষা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। কভিড-১৯ রোগী শনাক্তে বর্তমানে শুধু ঢাকায় আইইডিসিআরে অসুস্থ ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে কারও পরীক্ষার প্রয়োজন হলে নমুনা পাঠানো হচ্ছে আইইডিসিআরে। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, ‘রোগটি পরীক্ষার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের রোগীর সংখ্যা এখন আস্তে আস্তে বাড়ছে। অ্যাপোডেমিক্যালি এটা প্রত্যাশিত যে কিছু রোগী বাড়বে। সেদিক থেকে এ রোগের পরীক্ষাটি আমরা আইইডিসিআরে আর কত দিন রাখব এবং ব্যাকআপ হিসেবে কোন কোন ল্যাবে যাবে, তা ঠিক করা ছিল। এর পরও আমরা পরিকল্পনাটি আরও আপডেট করছি। এক সপ্তাহের মধ্যে কিছু কিছু ল্যাবে আমরা পরীক্ষার ব্যবস্থা করব।’ কিন্তু নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থাটা আইইডিসিআরের সার্বিক তত্ত্বাবধানেই হবে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ফ্লোরা।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যানুসারে, কোয়ারেন্টাইনে আছেন কুমিল্লায় ৩১২, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩০০, শরীয়তপুরে ২২৩, কিশোরগঞ্জে ২১৪, লক্ষ্মীপুরে ২১৪, চট্টগ্রামে ৯১, বগুড়ায় ৬৯, বরিশালে ৬১, নারায়ণগঞ্জে ৫৫, হবিগঞ্জে ৫৩, নরসিংদীতে ৪৪, গাইবান্ধায় ৪৪, বরগুনায় ৩৮, সাতক্ষীরায় ৩৭, নীলফামারীতে ৩৫, পিরোজপুরে ৩২, বাগেরহাটে ৩০, জামালপুরে ২৯, খুলনায় ২৭, গাজীপুরে ২০, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৪, নেত্রকোনায় ৯ ও রাঙামাটিতে ৬ জন।

বিদেশ থেকে আসছে অনেক, কিন্তু কোয়ারেন্টাইন কম : করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলো থেকে ফিরে আসার সংখ্যা অনেক বেশি হলেও কোয়ারেন্টাইনে কমসংখ্যক পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে বরিশালে গত কয়েক দিনে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার জন ফিরলেও কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন ৬০ জন। বাগেরহাটে ৩ হাজার ৩০০ জন ফিরলেও কোয়ারেন্টাইনে আছেন মাত্র ৩০ জন। নারায়ণগঞ্জে ৫ হাজার ৩৯ জন ফিরলেও কোয়ারেন্টাইনে ৫৫ জন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৮ হাজার ৭৬৭ জন ফিরলেও কোয়ারেন্টাইনে মাত্র ১৪ জন। লক্ষ্মীপুরে ৩ হাজার ৬৬২ জন ফিরেছেন কিন্তু হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ২১৪ জন।

হোম কোয়ারেন্টাইন অমান্যে ৩০ জনের দন্ড : সরকারি নির্দেশ অমান্য করে বিভিন্ন জনের ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগে ১৭ জেলায় ৩০ জনকে অর্থদন্ড দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ প্রবাসীকে ৫৫ হাজার, কক্সবাজারে তিনজনকে ৪০ হাজার, নারায়ণগঞ্জে তিনজনকে ২০ হাজার, মৌলভীবাজারে তিনজনকে ১৫ হাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুজনকে ১০ হাজার, নওগাঁয় একজনকে ১ হাজার, মানিকগঞ্জে একজনকে ৫ হাজার, জামালপুরে একজনকে ১০ হাজার, কুমিল্লায় চার সদস্যের পরিবারকে ১০ হাজার, সুনামগঞ্জে একজনকে ১০ হাজার, টাঙ্গাইলে দুজনকে ২০ হাজার, হবিগঞ্জে একজনকে ১০ হাজার, মাদারীপুরে দুজনকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

টেস্ট কিটসহ জরুরি সেবা দেবে চীন : করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশকে বিপুলসংখ্যক টেস্ট কিটসহ জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন। এ বিষয়ে ঢাকার চীন দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে দূতাবাস। গতকাল ঢাকার চীনা দূতাবাস জানায়, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশকে বিপুলসংখ্যক টেস্ট কিটসহ জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন। চীনের ঢাকার দূতাবাস থেকে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকেও এ তথ্য জানানো হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য করোনা মহামারী রোধে চীন বরাবরই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অংশীদার ছিল, আগামীতেও থাকবে।

হোম কোয়ারেন্টাইনে সচিব, বিচারক, চিকিৎসক : সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরা সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ের সচিব হোম কেয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বিচারিক আদালতের ৩০ জন বিচারককে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে ১৫ মার্চ তারা দেশে ফিরেছেন। সেদিন থেকেই তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চার চিকিৎসককে। এই চিকিৎসকদের কেউই আক্রান্ত নন। যেহেতু তারা ১০ রোগীকে অ্যাটেইন করেছিলেন, তাদের মধ্যে চারজনের রক্তে পজিটিভ এসেছিল, ফলে এই চিকিৎসকদের হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। ভারত থেকে ১৬ মার্চ দেশে ফেরা বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকও হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন।

স্পেনে ১৬ বাংলাদেশি আক্রান্ত : স্পেনে করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত ১৬ জন বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন। রাজধানী মাদ্রিদে ১৫ জন ও কাতালোনিয়ার বার্সেলোনায় একজন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মাদ্রিদে যে ১৫ জন বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১০ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাকি পাঁচজন হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। এ পাঁচজনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

করোনাভাইরাস কমিউনিটিতে সংক্রমিত হচ্ছে, মনে করে ব্র্যাক : যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলেও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক মনে করে, করোনাভাইরাস দেশের কমিউনিটিতে সংক্রমিত হচ্ছে। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ গতকাল সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন। আসিফ সালেহ বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠনের একটি সেল গঠন করা হয়েছে। ব্র্যাক ওই সেলের সদস্য।

সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ ঘোষণা এডিবির, পাবে বাংলাদেশও : করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে ৬৫০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা) ঋণ ঘোষণা করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির সদস্যভুক্ত ৬৮টি দেশ এই সহজ শর্তের ঋণ ব্যবহার করতে পারবে। কনসেশনাল এ ঋণে সুদের হার হবে ২ শতাংশ। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এই ঋণ ব্যবহার করা হবে বলে জানায় এডিবি। গতকাল এডিবির ঢাকা অফিসের পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এ প্রসঙ্গে এডিবির টিম লিডার (বহিঃসম্পর্ক বিভাগ) গোবিন্দ বার জানান যে, করোনা মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ঘোষণা করেছে এডিবি। চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশসহ এডিবির সদস্যভুক্ত দেশ এই ঋণ ব্যবহার করতে পারবে।

সর্বশেষ খবর