বৃহস্পতিবার, ১৯ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

কেঁপে উঠল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল

মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া

কেঁপে উঠল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল

১৯৭১ সালের মার্চ। আমি তখন ‘ল’-তে ভর্তি হয়েছি। এ ছাড়া সেগুনবাগিচায় মিউজিক কলেজে পড়ি। সেখানেই হোস্টেলে থাকতাম। বারীন মজুমদার কলেজটির প্রিন্সিপাল। বাপ্পা মজুমদারের বাবা। বারীন মজুমদার ও ইলা মজুমদারের পরিবার কলেজের দোতলায় থাকতেন। ২৫ মার্চ রাতে ভয়াবহ গোলাগুলি শুরু হলো। আমরা লাইট বন্ধ করে মিউজিক কলেজের ছাদে গেলাম। পাক হানাদাররা মিউজিক কলেজের গেটে কয়েকটি লাথি দিয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে চলে গেল। ভোর হতেই আমরা সেগুনবাগিচা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট কালু চাচার বাসায় গেলাম। ২৬ তারিখ সারা দিন কারফিউ। ২৭ তারিখ দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে বন্ধু আনুকে নিয়ে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জগন্নাথ হলে গিয়ে দেখলাম মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে লাশ। কারও হাত বেরিয়ে আছে। কারও পা। কারও চুল। সদরঘাটে গিয়ে দেখি শত শত লাশ। কোনোটি নদীতে, কোনোটি পন্টুনে। লাশের ওপর লাশ। হাজারো মানুষ তখন মরিয়া হয়ে ঢাকা ছাড়ছে। আমরা গেন্ডারিয়া, লালবাগ হয়ে ৩০ মার্চ জিনজিরায় আশ্রয় নিলাম। সঙ্গে বারীন মজুমদারের পরিবার। পরিকল্পনা ছিল ভারত যাব। ১ এপ্রিল সকালে পাক হানাদার বাহিনী জিনজিরা আক্রমণ করে বসে। বাপ্পা মজুমদার তখন ইলা বৌদির গর্ভে। আমি আর আনু তাকে দুই পাশ থেকে ধরে ছোটার চেষ্টা করছি। পালাতে গিয়ে হারিয়ে যায় বারীন দার নয় বছরের মেয়ে মিতু। সেই ঘটনার পর বারীন দা মেয়ের অপেক্ষায় সেখানেই থেকে গেলেন। আনু আর আমি ফিরলাম ঢাকায়। যুদ্ধে যাব। গাজী দস্তগীর, ফতেহ আলী, পুলু, সিরাজ, আনু, বকুল, সাঈদসহ ১১ জন একত্র হয়ে আগরতলা গেলাম। প্রশিক্ষণ নিলাম। ২ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্বে তখন খালেদ মোশাররফ। জুন মাসে খালেদ মোশাররফ আমাদের মধ্যে থেকে বেছে বেছে ১২ জন করে চারটি দল করলেন। বললেন, ৭, ৮, ৯ জুন পাকিস্তানের একটা বড় টিম আসবে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে উঠবে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঢাকায় সব কিছু স্বাভাবিক দেখানোর জন্য সেখানে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এক সম্মেলনের আয়োজন করেছে। সেখানে প্রিন্স সদর উদ্দিন আগা খানসহ বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি, বিদেশি সাংবাদিকরা থাকবেন। হোটেলে হামলা চালানো কঠিন হবে। ঢাকার আশপাশে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি তাদের জানান দিতে হবে। আমরা ভাবলাম, আশপাশে কেন, ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বোমা ফাটাব। ৬ তারিখ বিকালে হোটেল রেকি করে আসলাম। কিন্তু অপারেশনের পর পালাতে গাড়ি দরকার। পাকিস্তান টেলিভিশনের (বর্তমান বিটিভি) চিফ ক্যামেরাম্যান বাদলের সহযোগিতায় টেলিভিশনের একটি গাড়ি ছিনতাই করলাম। গাড়ি নিয়ে আমরা যখন ইন্টারকন্টিনেন্টালে গেলাম, কাকতালীয়ভাবে তখনই বিদেশি প্রতিনিধি দলটিকে নিয়ে পাকিস্তানের কয়েকজন জেনারেল ঢাকা শহর ঘুরে এসে হোটেলে নেমেছেন। আমরা দুটো গ্রেনেড ছুড়ে দিলাম তাদের দিকে। দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেল। আরও দুটো ছুড়ে দিয়েই গাড়িতে উঠে দিলাম টান। যেতে যেতেই শোনলাম দ্রিম দ্রিম করে চারটা গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ। এরপর চলে আসি আলমের বাসায়। আলম, জিয়া, আনু আর আমি। আলমের বাবা দৌড়ে এসে বললেন, ‘‘কারা যেন ইন্টারকন্টিনেন্টালে বোমা মেরেছে। বিদেশি যারা এসেছিল সবাই মারা গেছে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, দূরদর্শন- সবাই খবরে বলছে।’’ ৮ জুন সারা বিশ্ব জেনে যায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশে গেরিলা যুদ্ধ চলছে। ওই রাতেই সম্পূর্ণ হোটেল খালি। পরদিন আমরা গ্রেনেডের পিনগুলো নিয়ে আগরতলা গেলে খালেদ মোশাররফসহ সবাই বাহবা দিলেন। এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করায় আমাদের নাম দেওয়া হলো ক্র্যাক প্লাটুন। ইন্টারকন্টিনেন্টালে অপারেশনের পর আমরা মগবাজারে জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বাড়ি ও তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকায় বোমা হামলা চালাই। হোটেলটিতে দ্বিতীয় অপারেশন করি ১১ আগস্ট। হোটেলে তখন খুব কড়াকড়ি। একটি ভুয়া কাজের অর্ডার নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করি আমি, বাকের, সামাদ ও গাজী। সঙ্গে ২৮ পাউন্ড বিস্ফোরক আর টাইম পেনসিল বোমা। টয়লেটে টাইম বোমা ফিট করে বিস্ফোরক ভরা ব্রিফকেস কমোডের পেছনে রেখে চলে আসি। ৫টা ৫৬ মিনিটে হোটেল কাঁপিয়ে বিস্ফোরিত হয় টাইমবোমা । চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় হোটেল লাউঞ্জ, দেয়াল, শপিং আর্কেডের দরজা-জানালা। লেখক : আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

সর্বশেষ খবর