শনিবার, ২১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না প্রবাসীদের

কোয়ারেন্টাইন এড়াতে তথ্য গোপন কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক

খাগড়াছড়ি জেলায় বিদেশ থেকে ফিরেছেন ২৬৪ জন। তাদের মধ্যে শুধু একজনকে আইসোলেশনে এবং ১৩ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। বাকিরা লাপাত্তা। তাদের খোঁজ নিতে এখন পুলিশ মাঠে। পঞ্চগড়ে বিদেশ ফেরতের সংখ্যা ৯ শতাধিক। তবে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন মাত্র ৯ জন। অন্যদের বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগে কোনো তথ্য নেই। ৫ হাজারের বেশি প্রবাসী নারায়ণগঞ্জে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন মাত্র ৭৩ জন। বাকিদের খুঁজে বের করতে হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা। ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে এই প্রবাসীদের। চলতি মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২৪৩ জন প্রবাসী রাঙামাটিতে এসেছেন। এদের মধ্যে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন মাত্র ১৫ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছে, কোয়ারেন্টাইন এড়াতে প্রবাসীরা তথ্য গোপন করছেন। বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের খুঁজে না পাওয়ার এমন চিত্র এখন সারা দেশের।

বিশ্বে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করার পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন কয়েক লাখ প্রবাসী। অধিকাংশ প্রবাসী এসেছেন ইতালি, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, দুবাই, লন্ডন, জর্ডানসহ করোনা আক্রান্ত বিভিন্ন দেশ থেকে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন বা ঘরে আলাদা থাকার কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই নিয়ম মানছেন না কেউ। হোম কোয়ারেন্টাইনের মধ্যেই বিদেশফেরত অনেকেই ঘুরছেন হাট-বাজারে। অনেকেই দিচ্ছেন বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের আড্ডা। অনেকে ছুটছেন শ্বশুরবাড়ি। প্রবাসীদের অনেকেই ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ থেকে বিয়ের আয়োজনও করে। কোয়ারেন্টাইন এড়াতে অনেকেই নিজেদের তথ্য পরিচয় পর্যন্ত গোপন করছেন। এ অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা স্থানীয়ভাবে ছড়াতে শুরু করেছে নভেল করোনাভাইরাস। হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে না পারলে এ রোগের বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

নভেল করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২০ জন, মারা গেছেন একজন। আক্রান্তদের বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আসা আত্মীয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন। এমনকি যিনি মারা গেছেন তিনিও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা তার মেয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। ইতিমধ্যে রোগীর সংস্পর্শে যাওয়াতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চার চিকিৎসক, বেসরকারি হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীর সংস্পর্শে আসায় এক চিকিৎসক এবং একজন নার্সকে আইসোলেশনে এবং অন্তত ২০ জনকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এসব রোগীদের থেকে আরও কতজন চিকিৎসকসহ অন্যরা সংক্রমিত হয়েছেন সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। আর এটা বোঝা না গেলে স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে যাবে। তখন পুরো দেশ ঝুঁকিতে পড়বে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্যানুযায়ী এখন পর্যন্ত দেশে আক্রান্তদের সবাই বিদেশ থেকে আসা আত্মীয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন। আইইডিসিআর পরিচালক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, বিদেশফেরতদের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ঠিকানা সংগ্রহ করে হোম কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু সেক্ষেত্রেও আমাদের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কেননা পাসপোর্টের ঠিকানায় অনেকেই বসবাস করেন না। আবার পাসপোর্টে ঠিকানা দেওয়া আছে, তবে অনেকে অন্য জায়গায় বাস করছেন। এতে করে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি এও বলেন, ইতিমধ্যে আক্রান্তরা যে উপজেলার বাসিন্দা, সেখান থেকে যেন রোগটি ছড়িয়ে না পড়তে পারে সেজন্য কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলা এবং উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে না পারলে এ রোগের বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করার উপায় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কৌশল হলো, দ্রুত রোগীকে শনাক্ত করে তাকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলা। তবে রোগের উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে করোনা রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হবে না বলেও জানান তিনি। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন যদি হয় সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রস্তুতি কেমন জানতে চাইলে অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, যদি সাবধানতা না নেওয়া হয় অর্থাৎ যে পরিবারের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে তাদের যদি বিচ্ছিন্ন করে রাখতে না পারি তাহলে এটা ছড়িয়ে যাবে, তবে প্রতিদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হবে সরকার সেই সিদ্ধান্ত নেবে। নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইমতিয়াজ জানান, পাঁচ হাজারের বেশি প্রবাসী জেলায় ফেরত এসেছেন। মাত্র ৭৩ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে আনা গেছে। অধিকাংশই কোয়ারেন্টাইনের বাইরে। তিনি বলেন, ‘আমরা উপজেলা কমিটিকে ফিরে আসা প্রবাসীদের তালিকা দিয়েছি। তারা ইউনিয়ন কমিটিকে দায়িত্ব দিয়েছে। তবে তালিকা অনুযায়ী অধিকাংশের ঠিকানায় গিয়ে তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না।’ এ ছাড়া বগুড়ায় বিদেশফেরত ৯৪ ব্যক্তির কোনো হদিস নেই। নাটোর জেলায় বিদেশফেরতের সংখ্যা ১২০০। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন মাত্র ২৭ জন। পাশাপাশি ১৪ দিনের বিশেষ মেয়াদ শেষে রিলিজ পেয়েছেন দুজন। খুলনায় দুই সপ্তাহে জেলায় দুই হাজার ৫৪৬ জন বিদেশ থেকে ফিরেছেন। কিন্তু মাত্র ৩০ জন হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। বাকি দুই হাজার ৫১৬ জনের খোঁজ মিলছে না। এ অবস্থায় স্থানীয় পর্যায়ে ভয়াবহভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভোলায় কাগজপত্রে গত দুই সপ্তাহে এক হাজার ৪৩০ জন বাসিন্দা দেশে ফিরেছেন। জেলায় এখন পর্যন্ত ১৭৫ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। কুমিল্লায় ১ হাজার ৪০০ জন প্রবাসী বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত এলেও হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন ৮৭০ জন। গতকাল দুপুরে জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, গত ১ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত তারা বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত এসেছেন। খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার আবদুল আজিজ জানান, ‘বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, বাহারাইনসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলার ২৬৪ জন নাগরিক দেশে এসেছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে নিজ দেশে প্রবেশ করার পর তারা নিজ জেলা খাগড়াছড়িতে এসেছেন কিনা বা এসে কোথায় অবস্থান করছেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন নূপুর কান্তি দাশ জানান, ‘করোনা আক্রান্ত সন্দেহে ভারত ফেরত এক নারীকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে এবং আরও ১৩ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর