শিরোনাম
রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় দেশে দ্বিতীয় মৃত্যু

নতুন ৪ সহ আক্রান্ত ২৪, কোয়ারেন্টাইনে ১৭৬৭৩, পুলিশ চিকিৎসক নার্স স্বাস্থ্যকর্মী ছুটি বাতিল, মিরপুরে ভবন লকডাউন, আমরা যুদ্ধাবস্থায় : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনায় দেশে দ্বিতীয় মৃত্যু

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। ৭৩ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ গতকাল আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুর পরই তার মিরপুরের বাসভবন ও আশপাশ এলাকা লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুজন মারা গেলেন। অবশ্য নিউইয়র্কে দুজন ও ইতালিতে একজন প্রবাসী বাংলাদেশির করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার খবর এসেছে। গতকাল বাংলাদেশে নতুন আরও চারজনের আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে মোট ২৪ জন আক্রান্ত হলেন। তবে আক্রান্ত সন্দেহে গতকাল পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে মোট ১৭ হাজার ৬৭৩ জনকে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশে সব ধরনের জরুরি সেবা অর্থাৎ পুলিশ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, চিকিৎসক, নার্স প্রত্যেকের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। চারটি দেশ ছাড়া অন্য সব দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ভাষায়, ‘আমরা এখন যুদ্ধাবস্থায় আছি।’ জানা যায়, গতকাল মারা যাওয়া বৃদ্ধ  বেশ কয়েক বছর আগে চাকরি থেকে অবসরে যান। তিনি গত মঙ্গলবার কল্যাণপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। তাঁর হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও রোগ ধরা পড়েনি। সেখানে অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় সেদিনই বিকালে তাঁকে মিরপুরের একটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যার কারণে একজন বক্ষব্যাধি চিকিৎসক তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। পরে মিরপুরের হাসপাতাল থেকে আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্ত ওই ব্যক্তি বিদেশফেরত নন কিংবা বিদেশফেরত কারও সংস্পর্শেও আসেননি বলে কিটের স্বল্পতার অজুহাতে আইইডিসিআর তাঁর করোনা পরীক্ষা করেনি। পরে সরকারের উচ্চপদস্থ লোকজনের তদবিরের পর পরীক্ষা করা হয়। শুক্রবার রাতে মিরপুরের ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হয় রোগী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ছিলেন। সম্প্রতি ওই বৃদ্ধের মেয়েজামাই প্রবাস থেকে এসেছেন বলেও জানা যায়।

মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ জানান, আইইডিসিআরের নির্দেশনা মেনে মৃত ব্যক্তিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আইইডিসিআরের নির্দেশে মিরপুরের টোলারবাগের বাসাটিকে কোয়ারেন্টাইন করা হয়। পরিবারের সদস্যরা হাসপাতাল-সংলগ্ন ওই ভবনে থাকেন। তাই সংক্রমণ যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্য ওই ভবনের বাসিন্দাদের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে। তারা কেউ যেন বের না হন তার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পরই বন্ধ রাখা হয়েছে ওই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)। কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে আইসিইউর চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয়দের। পরে দুপুরে রাজধানীর মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতরের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। তিনি বলেন, ভাইরাস আক্রান্ত মোট ২৪ জনের মধ্যে তিনজন সুস্থ হয়ে ইতিমধ্যেই বাড়ি ফিরে গেছেন। বাকি ১৯ জন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

মিরপুরে আরও ৪০ ভবন লকডাউন : রাজধানীর মিরপুর-১ এর উত্তর টোলারবাগের আরও ৪০টি ভবন পুলিশের সহায়তায় লকডাউন করেছে স্থানীয়রা। এর আগে দুপুরে একই এলাকার একটি ভবন লকডাউন করেছিল স্থানীয়রা। ওই ভবনে একজন করোনা রোগী মারা যাওয়ায় সে ভবনটি লকডাউন করা হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পর ওই এলাকায় স্থানীয়দের মাঝে নানা শঙ্কা দেখা দেয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ওই ভবনটির আশপাশের ৪০টি ভবন লকডাউন করা হয়েছে।

চীন থেকে ২০ হাজার কিট-পিপিই আনছে সরকার : করোনাভাইরাস শনাক্তে চীন থেকে প্রথম দফায় সরকারিভাবে ১০ হাজার টেস্টিং কিট ও ১০ হাজার ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) আনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছেÑ কিটস, সুরক্ষা ইকুইপমেন্ট নেই। আমরা ইতিমধ্যে আনার ব্যবস্থা করেছি। চীন রেডি রেখেছে। আমরা তাদের অনেক ইকুইপমেন্ট দিতে বলে রেখেছিলাম। ইতিমধ্যে ১০ হাজার টেস্টিং কিটস ও ১০ হাজার প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট রেডি আছে। যে কোনো সময় চার্টার্ড ফ্লাইটে এগুলো চলে আসবে।’ সরকারের বাইরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও চীন থেকে এগুলো আনার চেষ্টা করছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রয়োজনে আমরা চার্টার্ড ফ্লাইটে সেগুলো নিয়ে আসব।’ এ পরিস্থিতিতে জরুরি সেবা খাতের ব্যক্তিদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, এসেনশিয়াল সার্ভিস মানে পুলিশ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করেন, চিকিৎসক, নার্সÑ প্রত্যেকেরই ছুটি এ মুহূর্তে বাতিল করেছে সরকার।

দিয়াবাড়ীতে নয়, কোয়ারেন্টাইন হবে দুই হাসপাতালে : রাজউকের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের (আবাসিক) একটি ভবনে করোনাভাইরাসের কোয়ারেন্টাইন সেন্টার খোলার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট ও শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইন করা হবে। এ দুটি হাসপাতালে যে কোনো সময় উচ্চতর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

সব হাসপাতালে দর্শনার্থী নিষিদ্ধ, বিএসএমএমইউতে নিয়মিত রোগী ভর্তি বন্ধ : গতকাল থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত দেশের সব হাসপাতালে দর্শনার্থী নিষিদ্ধ করেছে সরকার। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়মিত রোগী ভর্তি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে জরুরি ভর্তি চালু থাকবে। গতকাল থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে কর্মরত শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুরক্ষায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিমান চলাচল বন্ধ : করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ ঠেকাতে ভারতসহ ১০টি দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ করেছে বাংলাদেশ। অন্য দেশগুলো হচ্ছেÑ সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ওমান ও সিঙ্গাপুর। ১০টি দেশের সঙ্গে শনিবার মধ্যরাত থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিমান চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক এ এইচ এম তৌহিদ উল আহসান বলেন, এ দেশগুলো থেকে কোনো ফ্লাইট ঢাকায় অবতরণ করতে পারবে না। এ-সংক্রান্ত নোটিস টু এয়ারম্যান (নোটাম) জারি করেছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ২১-৩১ মার্চ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। নতুন করে ১০টি দেশের ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্ত জানানোর পাশাপাশি কয়েকটি দেশের ফ্লাইট চালু রাখার যুক্তি তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, জরুরি যোগাযোগের জন্য ইউকে, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের ফ্লাইট চালু রাখা হয়েছে। যাতে কারও জরুরি বা বিশেষ প্রয়োজন হলে সেই রুটগুলো নিতে পারে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসা নতুন বন্দীরা কোয়ারেন্টাইনে : কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসা নতুন বন্দীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে। ১১ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রায় ২৫০ জন বন্দীকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। বন্দীদের মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করছে। আদালত থেকে কোনো আসামি এলে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ানো হচ্ছে এবং থারমাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে কারাগারের ভিতরে প্রবেশ করানো হচ্ছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান বলেন, নতুন বন্দীদের মধ্যে যাদের সর্দি, কাশি রয়েছে তাদের সম্পূর্ণভাবে আলাদা রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কারাগারে কোনো বন্দী আইসোলেশনে নেই। তবে গত বৃহস্পতিবার এক বন্দী গাজীপুর কারাগার থেকে এসেছিলেন। তার অবস্থা সন্দেহজনক হওয়ায় কুর্মিটোলার আইসোলেশন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির দাফনে বিশেষ নির্দেশনা : শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি নন, আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির শরীর থেকেও এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তাই এ রোগে মৃত ব্যক্তিকে পরিষ্কার করা বা ধোয়া বা গোসল করানো যাবে না। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়া ছোঁয়াও যাবে না। করোনা রোগে মৃত ব্যক্তির দাফন বা সৎকারসংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনায় এমন সতর্কতার কথা বলা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রটোকল অনুযায়ী নির্দেশনাটি তৈরি করা হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা সন্দেহভাজন কেউ মারা গেলে মৃতদেহ সরানো, সৎকার বা দাফন শুরুর আগে অবশ্যই সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) জানাতে হবে। তখন চার সদস্যের একটি দল সম্পূর্ণ সুরক্ষা পোশাক পরে মৃতদেহ সৎকার বা দাফনের জন্য প্রস্তুত করবে। মৃত্যুর স্থানেই মৃতদেহ প্লাস্টিকের কাভার দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে হবে। দলের নেতা মৃত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের নির্দিষ্ট কোনো অনুরোধ থাকলে তা জেনে নেবেন। কোথায় কবর দেওয়া হবে, তাও ঠিক করে রাখতে হবে।

কাতারে কোয়ারেন্টাইনে দেড় হাজার বাংলাদেশি : গতকাল কাতার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে সে দেশে দেড় হাজার বাংলাদেশি কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। কাতারে গতকাল নতুন করে আরও ১০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭০-এ। এ পর্যন্ত কাতারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন ১০ জন। আর নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৯ হাজারের বেশি মানুষের। আরও জানানো হয়েছে, করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য বিস্তার ও সংক্রমণ ঠেকাতে কাতারজুড়ে প্রতিনিয়ত নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ১৮ মার্চ থেকে কাতারে কেবল কাতারের নাগরিক ছাড়া সবার প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে পণ্যবাহী ও ট্রানজিটের ফ্লাইট আগমন অব্যাহত রয়েছে।

সর্বশেষ খবর