বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ইতালি স্পেনে লাশের গন্ধ, ভারত লকডাউন

বিশ্বে মৃত্যুর মিছিল ছাড়িয়েছে ১৮ হাজার, যুক্তরাজ্য লকডাউন, সৌদিসহ দেশে দেশে কারফিউ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

ইতালি স্পেনে লাশের গন্ধ, ভারত লকডাউন

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অনেকটা মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে ইউরোপের দেশ ইতালি ও স্পেন। ইতালির বাতাসে ভাসছে লাশের গন্ধ। এরপর ইউরোপের সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশ স্পেন। সেখানকার কেয়ার হোমগুলোতে মৃত অবস্থায় বেশ কয়েকজন বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ রোগীকে পাওয়া গেছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। যুক্তরাজ্যের পর ভারতজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল এ ঘোষণা দিয়ে ২১ দিন পর্যন্ত জনগণকে ঘর থেকে বের না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যাওয়ায় এ লকডাউন ঘোষণা। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এ লকডাউন জারি থাকবে। ওই সময়ে দেশের কোনো নাগরিকের বাড়ির বাইরে পা রাখা উচিত নয় বলে জানিয়ে দিলেন মোদি। একই সংগে তিনি এও জানিয়েছেন, ভারত সরকার ১৫ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ করেছে করোনা মোকাবিলার জন্য। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘২১ দিনের লকডাউন দীর্ঘ সময়, কিন্তু আপনাদের জীবন আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমার বিশ্বাস, প্রত্যেক ভারতবাসী সরকারের নির্দেশ মেনে চলবেন। আশা করি খুব শিগগিরই এ সংকট কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারব আমরা।’ তিনি বলেন, ‘আপনাদের কাছে অনুরোধ, এ সংকটের সময় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাবেন না। আমার বিশ্বাস, প্রত্যেক ভারতীয় সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলবেন। এ সংকটের সময় নানারকম গুজবও ছড়াচ্ছে। এ ধরনের গুজব ও কুসংস্কার এড়িয়ে চলুন। শুধু কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নির্দেশ মেনে চলুন।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেডরস অ্যাডানম গেব্রিয়ুস জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। কারণ  করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ থেকে ১ লাখে পৌঁছাতে ৬৭ দিন সময় লেগেছে। দ্বিতীয় এক লাখ আক্রান্ত হতে সময় লেগেছে ১১ দিন। কিন্তু তৃতীয় এক লাখ আক্রান্ত হতে সময় লেগেছে মাত্র ৪ দিন। বিশ্বব্যাপী ১৯৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে গতকাল রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৯ হাজার ৩৫৫ জন। মৃত্যু হয়েছে ১৮ হাজার ২৭৪ জনের। এর মধ্যে শুধু ইতালিতেই মৃত্যু হয়েছে ৬৮২০ জনের। চীনে মোট মৃত্যুর তুলনায় এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। চীনে মৃত্যু হয়েছে ৩২৭৭ জনের। স্পেনে মৃত্যুর  সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ২৮০০ জন। ইতালিতে মৃত্যুর এই মহামারীর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন সেদেশের একজন শিক্ষক। দক্ষিণ ইতালি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিঙ্কি সরকারের মতে, করোনাভাইরাস নিয়ে ইতালি সরকারের উদাসীন মনোভাবই এর প্রধান কারণ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনসাধারণের চরম উদাসীনতা। লকডাউনের গুরুত্ব না বুঝে সকাল-বিকাল আড্ডা দিতে বেরিয়েছেন অনেকেই। তাদের ধারণা ছিল, একটু বেরোলে কী আর এমন হবে। পিঙ্কি সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেন, জানুয়ারিতে করোনাভাইরাসকে কেউ সেভাবে পাত্তা দেয়নি। বুঝতেই পারেননি রোগের গুরুত্ব। ফলে সংক্রমণ ছড়াতে ছড়াতে এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, বিনা নোটিসে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাতে সবাই ছুটির মুডে টাইমপাস করতে থাকেন রেস্তোরাঁ, শপিং মল, বাজার-হাটে। কারফিউ জারির পরও সবাই ভেবেছিলেন ঠিক হয়ে যাবে। অথচ মাত্র এক মাসের মাথায় ইতালিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ হাজারের মতো মানুষ। আর মৃতের সংখ্যা ৬ হাজারেরও বেশি। তাই ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তের কণ্ঠে হতাশা ও ভেঙে পড়ার সুর। টুইটারে তিনি বলেছেন, আমরা সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারা গেছি। আর কী করতে হবে তা আমরা জানি না। পৃথিবীর সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গেছে। এখন একমাত্র সমাধান আকাশের কাছে। তার এ বক্তব্য বিশ্ববাসীকে নাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে স্পেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্গারিতা রবলেস বলেছেন, অবসরকালীন হোমে বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে যে রকম আচরণ করা হচ্ছে তা নিয়ে কঠোর ও অনমনীয় হবে সরকার। নির্দিষ্ট কিছু স্থানে পরিদর্শনে গিয়ে সেনাবাহিনী কিছু বয়স্ক ব্যক্তিকে পুরোপুরি পরিত্যক্ত অবস্থায় এমনকি কয়েকজনকে তাদের বিছানায় মৃত অবস্থায়ও পেয়েছে। করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর কিছু কেয়ার হোমের কর্মীরা কর্মস্থল ছেড়ে গেছেন বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।  স্পেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালভাদর ইলা জানিয়েছেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এসব কেয়ার হোমের মৃত বাসিন্দাদের দেহগুলো শেষকৃত্যের জন্য সংগ্রহ না করা পর্যন্ত কোল্ড স্টোরেজে রাখা হয়।  কিন্তু যখন মৃত্যুর কারণ করোনাভাইরাস বলে সন্দেহ করা হয় তখন উপযুক্ত পোশাকে সজ্জিত শেষকৃত্য কর্মীরা না আসা পর্যন্ত এসব মৃতদেহ তাদের বিছানায়ই রেখে দেওয়া হয়।

 করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে রাজধানী মাদ্রিদে। এখানে ওই ধরনের লাশগুলো সরিয়ে নিতে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। মাদ্রিদে সংকট ঘনীভূত হওয়ায় নগর কর্তৃপক্ষের দাফন দফতর জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় সুরক্ষা উপকরণ না থাকায় মঙ্গলবার থেকে তারা করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া রোগীদের লাশ সংগ্রহ বন্ধ রাখবে। মিয়ানমারে দুজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যফেরত এ দুজনই দেশটির প্রথম করোনা রোগী। করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল যে দেশে, সেই চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এমনকি দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে উভয় দেশে তাদের নাগরিকদের অবাধ যাতায়াত ও যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু উহানে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে দেশের সব প্রবেশপথে কড়াকড়ি আরোপ করে মিয়ানমার সরকার। তারই ফলে করোনাকে প্রায় তিন মাস ঠেকিয়ে রাখা গেছে বলে দাবি করে মিয়ানমার।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্যানুসারে, আফগানিস্তানে নতুন আসা ন্যাটোর চার সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। চীনে নতুন করে আক্রান্ত ৭৮ জন। এর মধ্যে ৭৪ জনই দেশের বাইরে থেকে আসা। চীনে বাইরে থেকে আসা ব্যক্তিদের কারণে দ্বিতীয় দফা করোনা ঢেউয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে করোনার উৎপত্তিস্থল চীনের উহানসহ হুবেই প্রদেশে ভ্রমণ বিধিনিষেধ উঠে যাচ্ছে শিগগিরই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা বাণিজ্য শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছেন। যদিও বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্য এখনো বন্ধ। নাগরিকদের চলাফেরায় আরও কড়াকড়ি আরোপ করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলছেন, ‘আপনাদের অবশ্যই ঘরে থাকতে হবে।’

জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এক লাখের বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়েছেন, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৩০ ভাগ। সুস্থ হওয়া অর্ধেকের বেশি চীনের।

পশ্চিমবঙ্গে লকডাউনের সময়সীমা বেড়ে ৩১ মার্চ

করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা ও গুরুত্ব বিচার করে পশ্চিমবঙ্গে লকডাউনের সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সোমবার বিকাল ৫টা থেকে কার্যত গোটা পশ্চিমবঙ্গ জারি করা হয় ‘লকডাউন’, যার সময়সীমা ছিল ২৭ মার্চ রাত ১২টা পর্যন্ত। কিন্তু গতকাল রাজ্য সরকারের পক্ষে একটি নতুন নির্দেশিকা জারি করে তা আগামী ৩১ তারিখ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কলকাতাসহ রাজ্যের সাতটি জেলার সম্পূর্ণ এলাকা, কয়েকটি জেলা সদর আবার কোথাও পৌরসভার এলাকাগুলো এই লকডাউনের আওতায় পড়ছে।

এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি জানান, ‘পরিস্থিতি বিচার করে লকডাউনের মেয়াদ ৩১ মার্চ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর