বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

স্মৃতির পাতায় পঁচিশে মার্চ

তোফায়েল আহমেদ

স্মৃতির পাতায় পঁচিশে মার্চ

১৯৭১-এর পঁচিশে মার্চ ছিল বৃহস্পতিবার। লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের ২৪তম দিবসের ভোর থেকেই অসংখ্য মিছিল সারা শহর প্রদক্ষিণ করতে থাকে। আজকের মিছিলের চরিত্র ছিল ভিন্নরূপ। মিছিলকারী সবার হাতেই ছিল নানারকম দেশি অস্ত্র। মূলত গতকাল থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, আজ কিছু একটা ঘটবে। ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্নেল ওসমানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডু ইউ থিংক দ্যাট টুমরো উইল বি এ ক্রুসিয়াল ডে?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘নো, আই থিংক, ইট উইল বি টুয়েন্টি ফিফথ্।’ কী নিখুঁত হিসাব বঙ্গবন্ধুর। হিসাব করেই তিনি বলেছিলেন, ২৫ মার্চেই পাকিস্তানিরা ক্র্যাকডাউন করবে। কেননা ২৫ মার্চে ডাকা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত করার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং জনাব ভুট্টো এ দিনটিতেই বাঙালি নিধনে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ প্রণয়ন করে রেখেছিলেন। আজ এটা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠল দুপুর ১২টায় যখন আমরা জানতে পারলাম, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার দলবলসহ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছেন। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আলোচনা করতে আসা সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও ইতিমধ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ আলোচনা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। অথচ গতকালও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে প্রায় ৪৫ মিনিট বৈঠক করে মি. ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘কোয়ালিশন সরকার গঠনের কথা’ আর আজ তাদের সব প্রস্তুতি হচ্ছে গণহত্যা সংঘটিত করা। এদিন বেলা ১১টায় সেনাবাহিনীর একটা হেলিকপ্টারে মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ এবং জেনারেল ওমর রংপুর গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে গণহত্যার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করে ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসাররা রংপুর ত্যাগ করেন। রংপুর থেকে সোজা রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পরিদর্শন শেষে বিকালে ঢাকা ফেরেন। এদিকে সর্বত্র চাউর হয়ে যায়, ইয়াহিয়ার প্রধান সাহায্যকারী উপদেষ্টা এম এম আহমদ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে আমরা জানতে পারি সব সংবাদ মাধ্যমকে এড়িয়ে গোপনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া করাচির উদ্দেশে যাত্রা করেন। এরপর ইয়াহিয়ার আরেক উপদেষ্টা এ কে ব্রোহীও ঢাকা ত্যাগ করেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি থমথমে রূপ ধারণ করে। আলোচনার নামে কালক্ষেপণকারী কুচক্রী মহলের নীলনকশা বাস্তবায়নের ভয়াল রাত ক্রমেই এগিয়ে আসতে থাকে।   

সকাল ৯টা থেকে আমি এবং মণি ভাই (শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ ফজলুল হক মণি) বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নেতার সান্নিধ্যেই ছিলাম। আমরা একবার ৩২-এ নেতার বাসভবনে যাই আবার সেখান থেকে বেরিয়ে তাঁর নির্দেশমতো কাজ করে আবার ৩২ নম্বরে আসি। এর মধ্যে একের পর এক মিছিল আসতে থাকে। মিছিলকারীদের উদ্দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সতর্ক থেকে সবার উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। অচিরেই আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক এক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হতে পারে এবং সেই যুদ্ধ আজ থেকে শুরু হলে অবাক হওয়ার কিছুই নাই। জনতার দাবিকে শক্তির দাপটে দাবিয়ে রাখার জন্য যদি কেউ রক্তচক্ষু প্রদর্শন করে আমরা তা বরদাস্ত করব না। যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র আমরা নিশ্চিহ্ন করে দেব।’ দুপুর ১২টায় দলবলসহ ইয়াহিয়ার ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, শেখ আবদুল আজিজ, আবদুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, গাজী গোলাম মোস্তফা, খাজা আহমদ, মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, আবদুস সামাদ আজাদ, মতিউর রহমান, মশিউর রহমান, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং আমাদেরকে স্ব স্ব দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে প্রত্যেককে নিজ নিজ জেলা ও এলাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনার নির্দেশ দেন। তখন নেতৃবৃন্দের প্রত্যেকেই নেতার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনি আমাদেরকে বিদায় করছেন। আপনি কোথায় যাবেন?’ তখন তিনি উপস্থিত নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি জানি আজই তারা ক্র্যাকডাউন করবে। তবুও আমি এখানেই থাকব। কারণ, ওরা যদি আমাকে না পায়, তাহলে ঢাকা শহরকে ওরা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে। আর তাছাড়া আমি নীতিগতভাবে মনে করি যে, আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত নেতা। আমার পক্ষে পলায়ন করা সম্ভবপর নয়। এ ছাড়াও চতুর্দিকে কমান্ডো আছে আমি যদি কোথাও যেতে চাই তাহলে ওরা আমাকে হত্যা করবে। আমি তো আমার জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। আজ আমার জীবন সার্থক। আজ একটা সফল ধর্মঘট পালিত হয়েছে। বাংলার মানুষ আজ তাদের নির্বাচিত নেতার নির্দেশেই পরিচালিত হচ্ছে। এই তো প্রথম বাঙালিরা যে একদিন তাদের ভাগ্যনিয়ন্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আজকে বাঙালিরাই বাংলার ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়েছে।’ এর মধ্যে একজন বললেন, ‘ওরা তো আপনাকে হত্যা করবে।’ তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে হত্যা করে লাভ নাই। ওরা তো বারবার আমাকে কারাগারে নিয়েছে। আমাকে নির্যাতন করেছে। ওদের লাভ হয় নাই। আমাকে হত্যা করেও ওদের লাভ হবে না। কারণ আমার মতো লক্ষ মুজিবের জন্ম হবে বাংলাদেশে। আমি আজ তৃপ্ত। আমি যা চেয়েছি, আমি তা পেয়েছি। আমি জানি আমার স্বপ্ন পূরণ হবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। যে বাংলার দামাল ছেলেরা রক্ত দিতে শিখেছে, যে বাংলার ছেলেরা জীবন দিতে শিখেছে, সেই বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমাকে যদি হত্যা করে আর আমার মৃতদেহ যদি কেউ দেখে, দেখবে আমার মুখে হাসি। কারণ, আমি পরিতৃপ্ত। আমি যা চেয়েছি, আমি তা পেয়েছি।’

এ কথা বলে বঙ্গবন্ধু সবাইকে বিদায় জানান। রাতে আমি এবং মণি ভাই বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। আমাদের তিনি বুকে টেনে নিলেন। আদর করে বললেন, ‘আমি সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছি, যাও।’ কোথায় গেলে কী পাবে, সেসব সংক্ষেপে বলে আমাদের কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের দোয়া করি। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। তোমাদের আমি যে দায়িত্ব দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন কর।’

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে শিল্পপতি জহিরুল ইসলাম আমাকে একটা গাড়ি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর মণি ভাই সেই গাড়িতে রওনা দিই। রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে যখন যাই তখন সংগ্রামী জনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে। সেগুনবাগিচায় একটা প্রেসে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত লিফলেট ছিল। সেই লিফলেট নিয়ে যাব ফকিরাপুলে মণি ভাইয়ের বাসায়। প্রেস পর্যন্ত গেলাম, লিফলেট নিলাম। রাস্তায় ব্যারিকেড থাকার কারণে গাড়ি নিয়ে এগোনো গেল না। অগত্যা হেঁটেই রওনা দিলাম। এরপর রাত ১২টায় মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী শুরু করল ইতিহাসের পৈশাচিকতম হত্যাকান্ড। শুরু হলো বাঙালি নিধনযজ্ঞ তথা গণহত্যা। সে জন্যই ২৫ মার্চ বাঙালির ইতিহাসের কালরাত্রি। নিরস্ত্র-নিরপরাধ বাঙালির ওপর জঘন্য হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী পাকিস্তান রাষ্ট্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুঁকে দিয়েছে। চারদিকে প্রচ- বিস্ফোরণের শব্দ। আর আমার কানে তখন কেবলই বাজছে বিদায় বেলায় বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ, ‘তোমাদের যে দায়িত্ব আমি দিয়েছি, সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন কর। আমার জন্য ভেব না। আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, আমার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। ওরা অত্যাচার করবে, নির্যাতন করবে। কিন্তু আমার বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।[email protected]

সর্বশেষ খবর