রবিবার, ৫ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

মহামারীতে মিনিটে ৪ মৃত্যু

আক্রান্ত ১১ লাখ, মৃত্যু ৬০ হাজার, দিশেহারা যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য স্পেন ফ্রান্স ইতালি

প্রতিদিন ডেস্ক

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বিশ্বে মৃতের সংখ্যা এখন ৬১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্ত হয়েছেন ১১ লাখেরও বেশি মানুষ। প্রতি মিনিটে মারা যাচ্ছেন অন্তত ৪ জন করে। ফলে ভূমন্ডল রীতিমতো মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী, বর্তমানে ভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর শীর্ষ স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি ও যুক্তরাজ্য। ভাইরাস উৎপত্তির দেশ চীন এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেও বাকি বিশ্ব রয়েছে মহাবিপর্যয়ে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য বিশ্লেষণে জানানো হয়েছে, এক দিনে ৯ ঘণ্টার এক পরিসংখ্যানেই দেখা গেছে, করোনায় বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৫০ জন আক্রান্ত হচ্ছেন এবং ৪ জন মারা যাচ্ছেন। এ ছাড়া জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল এখনো ইউরোপ। যদিও ধীরে ধীরে সেই কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র। মৃত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম দুটি দেশই ইউরোপের। সবার ওপরে আছে ইতালি, তারপর স্পেন। এরপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। খবরে আরও বলা হচ্ছে, সামনে ভারতও হতে পারে নতুন মৃত্যুপুরী। দেশটির চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্ত এবং মৃত্যুতে ইউরোপকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে ভারত।

গত শুক্রবারের মৃত্যু তালিকা : শুক্রবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে নতুন মৃত্যুর তালিকায় শীর্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী, দেশটিতে এদিন ২৪ ঘণ্টায় মারা যান ১ হাজার ৩২১ জন। এরপর এ তালিকায় ছিল ফ্রান্সে ১ হাজার ১২০, স্পেনে ৮৫০, ইতালিতে ৭৬৬, যুক্তরাজ্যে ৬৮৪, জার্মানিতে ১৬৮, নেদারল্যান্ডসে ১৪৮, বেলজিয়ামে ১৩২, ইরানে ১৩৪ জন। বিভিন্ন দেশ মিলিয়ে এদিন মোট নতুন মৃত্যু ছিল ৫ হাজার ৯৯০ জন। এ ছাড়া এদিন ২৪ ঘণ্টায় নতুন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে ৩২ হাজার ২৮৪ জন, ফ্রান্সে ২৩ হাজার ৬০ জন, স্পেনে ৭ হাজার ১৩৪ জন, জার্মানিতে ৬ হাজার ৩৬৬ জন, ইতালিতে ৪ হাজার ৫৮৫ জন, যুক্তরাজ্যে ৪ হাজার ৪৫০ জন, তুর্কিতে ২ হাজার ৭৮৬ জন, ইরানে ২ হাজার ৭১৫ জন। সব দেশ মিলিয়ে এদিন মোট নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৫৭৮ জন।

ইউরোপকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ভারত : করোনাভাইরাস মহামারীর শিকার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে শীর্ষে উঠে এসেছে ভারত। গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ভারতে করোনা শনাক্ত হয় ২ হাজার ৫৬৭ জনের। আর পাকিস্তানে রোগী ছিল ২ হাজার ৬৩৭ জন। এক দিন আগেও পাকিস্তান ছিল শীর্ষে। ভারতে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৭৮ জনের। অন্যদিকে পাকিস্তানে মারা গেছেন ৪০ জন। এদিকে মুম্বাইয়ে এশিয়ার বৃহত্তম বস্তিতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একজন মারা যাওয়ার পর শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসকরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য ব্যাপক সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য ভারতকে অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে। যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পাশাপাশি করোনায় মৃত্যুপুরী ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ভারত। চিকিৎসকরা সতর্ক করে দিয়ে আরও বলেছেন, ভারতের অসংখ্য বস্তির একটিতেও যদি করোনার স্থায়ী প্রাদুর্ভাব শুরু হয়; তাহলে পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কারণ ভারতের অধিকাংশ বস্তিতে স্যানিটেশন এবং বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া হাজার হাজার মানুষ গাদাগাদি করে সেখানে জীবনযাপন করেন। এসব বস্তিতে সামাজিক দূরত্ব শারীরিক কিংবা অর্থনৈতিকভাবে বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব। চিকিৎসক নরেশ ত্রিহান বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের আলামত পেয়েছি। কিন্তু এটা কীভাবে ছড়াচ্ছে তা অজানা। আমরা যে ধরনের প্রস্তুতিই নেই না কেন, যখন এটি একেবারে চূড়ান্ত মাত্রায় সংক্রমণ ঘটাবে, তখন কী ঘটবে তা ভেবেই আঁতকে উঠি। আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় শয্যা, ভেন্টিলেটর, পিপিইর এক-চতুর্থাংশও নেই। এ সবকিছুই দরকার।’ এদিকে ভারতীয় গণমাধ্যম সংবাদ প্রতিদিনের এক সমীক্ষায় গতকাল বলা হয়েছে, জুনের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতে কভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

ইকুয়েডরের রাস্তায় লাশ : ইকুয়েডরের সবচেয়ে জনবহুল শহর গুয়াইয়াকিলে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে মানুষজন শুধু জনাকীর্ণ হাসপাতালে মারা যাচ্ছেন তাই-ই নয়, সেখানে মানুষকে রাস্তায় মরে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। খবরে বলা হচ্ছে, কভিড-১৯ এর কারণে বাড়িতে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের মরদেহগুলো সরিয়ে নিতেও কয়েক দিন সময় লেগে যাচ্ছে। কারণ মরদেহ সরিয়ে নেওয়ার তালিকা আর এর জন্য অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বিবিসি জানায়, যারা রাস্তায় পড়ে মারা যাচ্ছেন তাদের মৃত্যুর খবর রিপোর্ট করতে এবং মানুষকে সেটা জানাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা। কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি একটি হাসপাতালের বাইরে পড়ে আছেন এবং একটি বাড়ি থেকে লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য টায়ার জ্বালিয়ে জানান দেওয়া হচ্ছে।

লকডাউন ভাঙায় নাইজেরিয়ায় যুবককে গুলি করে হত্যা : সরকারি নিয়ম ভেঙে লকডাউনের সময় বাড়ির বাইরে আসতেই নাইজেরিয়ার সেনারা গুলি চালিয়ে এক যুকককে হত্যা করেছে। ওয়ারি শহরে এ ঘটনা ঘটেছে। নিহতের নাম জোসেফ পেসু। এএফপি ও আল জাজিরা জানাচ্ছে, নাইজেরিয়ার যে ডেলটার ওয়ারি শহরে লকডাউন চলছিল। এর মাঝে সরকারি হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে বাড়ি থেকে বের হওয়ায় জোসেফ পেসুকে গুলি করে মেরে ফেলে সেনাবাহিনী। এ ঘটনার পর শহরটিতে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। রাস্তায় নেমে স্থানীয় যুবকরা বেশ কিছু গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাস্ক ছিনতাইয়ের অভিযোগ : জার্মানির পথে থাকা দুই লাখ মাস্ক যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ব্যবহারের জন্য ছিনতাই করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে জার্মানি। দেশটি এ ঘটনাকে ‘আধুনিক দস্যুতা’ বলেও অভিহিত করেছে। বার্লিনের স্থানীয় শাসক বলেছে, তাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের জন্য আসা ওই মাস্কগুলো যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি বানিয়েছিল। পথিমধ্যে সিঙ্গাপুর থেকে সেগুলো ‘জব্দ করা হয়’; যে কারণে মাস্কগুলো আর নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছায়নি। অন্যদিকে বিবিসি জানায়, মার্কিন কোম্পানির বানানো ওই এফএফপি ২ মাস্কগুলো শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রেই ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে বার্লিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গিসেল অভিযোগ করেছেন। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি কোরিয়ান যুদ্ধের সময়কার একটি আইন সচল করে মার্কিন কোম্পানীগুলোকে নিজ দেশের চাহিদা অনুযায়ী মাস্ক, গ্লাভসসহ বিভিন্ন চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই আইনের আওতায় জার্মানির পথে থাকা এ মাস্কগুলো ‘জব্দ’ করা হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসে করোনাভাইরাস টাস্কফোর্সের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্যই এ সামগ্রীগুলো শিগগির দরকার আমাদের; নিজেদের ব্যবহারের জন্যই দরকার।’

মার্কিন ক্যাপ্টেনের বরখাস্তের বিরোধিতায় কংগ্রেস সদস্যরা : মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস থিওডোর রুজভেল্টের ক্যাপ্টেন ব্রেট ক্রোজিয়ারকে বরখাস্ত করার বিরোধিতা করেছেন দেশটির কংগ্রেস সদস্যরা। সরকারবিরোধী ডেমোক্র্যাট দলের সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যাপ্টেন ব্রেটকে বরখাস্ত করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কংগ্রেস সদস্যরা বিষয়টি তদন্ত করার জন্য পেন্টাগনের স্বতন্ত্র ইন্সপেক্টর জেনারেল গ্লেন ফাইনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটর রিচার্ড ব্লুমেন্থল এবং ক্রিস ভ্যান হোলেন এ বিষয়ে ইন্সপেক্টর জেনারেল ফাইনকে অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছেন এবং তাতে সই করেছেন আরও ১৫ জন কংগ্রেস সদস্য। এদিকে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য টেড লিউ এবং রুবেন গ্যালিগো ইন্সপেক্টর জেনারেল ফাইনকে লেখা আলাদা চিঠিতে বলেছেন, ‘এ ঘটনার দ্রুত তদন্ত করতে হবে। সাবেক সেনা কর্মকর্তা হিসেবে আমরা জানি যে, সেনাদের স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি যে কোনো কমান্ডারের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়।’

করোনায় মৃতদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করল চীন : জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে এবং দেশজুড়ে সব ধরনের বিনোদনমূলক কার্যক্রম বাতিল করে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসে নিহত কয়েক হাজার ‘শহীদ’কে স্মরণে করেছে চীন। গতকাল বেইজিং সময় সকাল ১০টায় চীনজুড়ে তিন মিনিট নীরবতা পালন করা হয় বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এ সময় গাড়ি, ট্রেন ও জাহাজ থেকে বাজানো হয় হর্ন, শোনা যায় সাইরেনের শব্দ। বেইজিংয়ের রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্র ঝোংনানহাইয়ে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংসহ চীনের শীর্ষ নেতারা জাতীয় পতাকার সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে মৃতদের প্রতি রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা জানান। শোকের স্মারক হিসেবে সেসময় তাদের বুকে পিন দিয়ে আটকানো ছিল সাদা ফুল। ফুলেল শ্রদ্ধা আর নীরবতায় দেশটির অন্যত্রও এদিন চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারির যোদ্ধাদেরসহ কভিড-১৯ এ নিহতদের স্মরণ করা হয়েছে। এক কোটি দশ লাখ বাসিন্দা অধ্যুষিত উহানেও এ সময় সব এলাকার ট্রাফিক সিগন্যালে তিন মিনিট লাল বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। সড়কগুলোতে থাকা সব গাড়ি এ সময় থমকে থাকে।

সর্বশেষ খবর