রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদের ফাঁসি

কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাত ১২টা ১ মিনিটে হলো কার্যকর

নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদের ফাঁসি

কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ। ইনসেটে মাজেদ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের মৃত্যুদন্ড ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয়েছে। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গতকাল দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকর করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংস হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্ক তিলক পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, গতকাল দিবাগত রাতে মাজেদের ফাঁসির মধ্য দিয়ে তা মোচনের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। আর এ কলঙ্ক মোচনের কাজটি শুরু হয়েছিল আজ থেকে ১১ বছর আগে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নারকীয় হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটতে থাকে একটি জঘন্যতম, লজ্জাজনক ও কালিমাময় ইতিহাসের। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর ময়নাতদন্ত ও অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে সালেহা বেগমের কাছে মাজেদের লাশ হস্তান্তর করা হয়। পরে পুলিশ পাহারায় লাশ পাঠানো হয় মাজেদের গ্রামের বাড়ি ভোলায়।

কারাসূত্র জানান, ফাঁসি দেওয়ার আগে কনডেম সেলে গিয়ে আবদুল মাজেদকে গোসল করিয়ে কারাগারের মাওলানার মাধ্যমে তওবা পড়িয়ে নেন কারা কর্তৃপক্ষ। এ সময় তার কাছ থেকে তার লাশ দাফনের বিষয়েও জেনে নেন কারা কর্তৃপক্ষ। ভোলায় গ্রামের বাড়িতেই লাশ দাফনের ইচ্ছাও জানান তিনি। রাত ১০টা ৫০ মিনিটে ধর্মীয় রীতি অনুসারে তওবা পড়ান কেন্দ্রীয় কারাগার মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মুফতি ফারদুল্লাহ। তওবার সময় মাজেদ অঝোরে কেঁদেছেন বলে জানিয়েছেন কারাসূত্র। এর আগেই তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন কারা চিকিৎসক। তওবা পড়ার কিছুক্ষণ পর কনডেম সেলে জল্লাদরা আসেন। রাত ১১টা ৫০ মিনিটে কনডেম সেল থেকে মাজেদকে নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। আগে থেকেই মঞ্চের পাশে রাখা ছিল লাশ বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স। ফাঁসির মঞ্চে নেওয়ার আগে দুই হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে, যমটুপি (কালো রঙের একটি বিশেষ টুপি) পরানো হয়। যমটুপি পরার আগে আবারও অজু করেছেন মাজেদ। এ সময় ফাঁসির মঞ্চের সামনে উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা। ফাঁসির মঞ্চে প্রস্তুত ছিলেন জল্লাদও। মঞ্চে তোলার পর কাঠের পাটাতনের ওপর দাঁড় করিয়ে তার দুই পা বাঁধা হয়। পরানো হয় ফাঁসির দড়ি।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ইকবাল কবিরের হাতে ছিল একটি রুমাল। রাত ঠিক ১২টা ০১ মিনিটে রুমালটি হাত থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জল্লাদ শাহজাহান ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেন। এতে মুহূর্তের মধ্যেই তার ঘাড়ের হাড় ভেঙে মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায় মাজেদের। আনুমানিক ২৫ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর মৃত্যু নিশ্চিত হলে লাশ নামিয়ে এনে হাত ও পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের সময় কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা, ঢাকার কারা উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ইকবাল কবিরসহ ফাঁসিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কারারক্ষীরা। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন, ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান, কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অমিত দেবনাথ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ। এর আগে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ওই রায় কার্যকরের আগেই ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান আসামি আজিজ পাশা। এখনো পলাতক রয়েছেন বঙ্গবন্ধুর আরও পাঁচ খুনি খন্দকার আবদুর রশীদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান। জানা গেছে, গতকাল বিকাল থেকেই কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ আশপাশ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সন্ধ্যায় জেলখানার মূল ফটক ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চারদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি ছিল র‌্যাব ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ। গত মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর মিরপুর থেকে দীর্ঘদিন পলাতক থাকা এই খুনিকে গ্রেফতার করেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা। পরে আদালতের মাধ্যমে তাকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর বুধবার তাকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হলে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মো. হেলাল চৌধুরী দন্ড কার্যকরের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। সেই পরোয়ানা কারাগারে পৌঁছালে কারা কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী আসামি মাজেদকে তা পড়ে শোনান। এরপর রাতেই নিজের সব দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন খুনি মাজেদ। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সে আবেদন খারিজ করে দেন। প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ হওয়ার পর এ দন্ড কার্যকরে সব বাধা দূর হয়। এদিকে মৃত্যুদ- কার্যকরের এক দিন আগেই বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদের সঙ্গে শেষ দেখা করে গেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। শুক্রবার কারা কর্তৃপক্ষের ডাকে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে দেখা করেছেন মাজেদের স্ত্রী সালেহা, স্ত্রীর বোন, বোনজামাই, ভাতিজা ও একজন চাচাশ্বশুর। ক্যাপ্টেন মাজেদের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে তার স্বজনদের সাক্ষাৎ করতে ডেকে নেন কারা কর্তৃপক্ষ।

করোনা ভয়ে দেশে এসে ধরা : মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর মিরপুর থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা গ্রেফতার করেন বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি আবদুল মাজেদকে। পরে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা তাকে গ্রেফতার করেছি। শিগগিরই তাকে আদালতে তোলা হবে।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তাকে বাংলাদেশেই পেয়েছি। হয়তো করোনার ভয়ে চলে এসেছেন।’

ফিরে দেখা: বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকান্ডের ঘটনায় থানায় একটি মামলা করেন।

১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এ মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাই কোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় প্রদান করে। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রাখেন। কিন্তু অন্য বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। পরে হাই কোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে ১২ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল থাকে। ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচারকাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে পাঁচ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন। ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করে। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।

সর্বশেষ খবর