সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

মৃত্যুর শেষ নেই বিশ্বে

সব দেশকে ছাড়াল যুক্তরাষ্ট্র

প্রতিদিন ডেস্ক

মৃত্যুর শেষ নেই বিশ্বে

করোনাভাইরাসে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী ও ক্ষমতাধর দেশগুলোও। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিও এখন এই ভাইরাসে বিধ্বস্ত ও দিশাহারা অবস্থায়। আক্রান্ত ও মৃত্যুতে দেশটি বর্তমানে সব দেশের শীর্ষে রয়েছে। পিছিয়ে নেই ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যও। সেখানেও মৃত্যু ও আক্রান্তের মিছিল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ইউরোপের অন্য দেশগুলোর অবস্থাও ভয়াবহ।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের মহামারীতে মৃত্যুর সব রেকর্ড ভেঙে এখন সবার শীর্ষে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত শনিবার পর্যন্ত দেশটিতে মারা গেছে ২১ হাজার ৪৩৫ জন। ইতালিতে মারা গেছে ১৯ হাজার ৮৯৯ জন। স্পেনে মারা যায় ১৬ হাজার ৯৭২ জন।

জনস হপকিন্সের পরিসংখ্যানে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য, ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া ও দেশটির নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য অঞ্চল মিলিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা অন্তত ৫ লাখ ১৪ হাজার ৪১৫ জনে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে গত শুক্রবার দৈনিক মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়, একদিনে মারা যায় ২ হাজার ৭৪ জন। এদিন শনাক্ত হওয়া নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার ৫৫১ জন। যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র ওয়াইওমিং বাদে আর সব অঙ্গরাজ্য থেকে মৃত্যুর খবর এসেছে।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সবকটিই করোনাভাইরাসের মহামারীতে পড়েছে। ভাইরাস মোকাবিলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এ পর্যন্ত যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে দেশটির জনগণ। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা এরই মধ্যে দ্রুতগতিতে কমতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, ঘরবন্দী আদেশ, যা অধিকাংশ আমেরিকানকে বাড়িতে অবস্থান করতে বাধ্য করছে, যদি ৩০ দিন পর তুলে নেওয়া হয় তাহলে গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে  যেতে পারে। মার্কিন জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ও ‘সার্জেন জেনারেল’ জেরোম অ্যাডামস শুক্রবার বলেছেন, ৯/?১১ নাশকতা এবং পার্ল হারবার আক্রান্ত হওয়া মার্কিন ইতিহাসের দুই ঐতিহাসিক ক্ষতির মুহূর্তের যুগ্ম সমাপতন হতে যাচ্ছে আগামী সপ্তাহে। ইউরোপের আরেক দেশ ফ্রান্সেও ভয়াবহ তা-ব চালাচ্ছে করোনা। সেখানে মারা গেছে ১৩ হাজার ৮৩৮ জন। এছাড়া ব্রিটেনে মারা গেছে ৯ হাজার ৮৭৫ জন। করোনাভাইরাসের মহামারীতে জার্মানিও বিধ্বস্ত। দেশটিতে মারা গেছে ২ হাজার ৮৭১ জন। ইরানে মারা গেছে ৪ হাজার ৩৫৭ জন এবং তুরস্কে প্রাণ হারিয়েছে ১ হাজার ১০১ জন। অন্যান্য দেশের মধ্যে শনিবার ২৪ ঘণ্টায় মারা যায় স্পেনে ৫২৫, ইতালিতে ৬১৯, ভারতে ৩৯, পাকিস্তানে ২০, সৌদি আরবে ৫, ইন্দোনেশিয়ায় ২১, আফগানিস্তানে ৩ জনসহ সব দেশ মিলিয়ে ৭ হাজার জন মারা যায়। এদিন পর্যন্ত বিশ্বে মোট করোনাক্রান্ত ছিল প্রায় ১৮ লাখ মানুষ এবং মোট মৃত্যু সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১২ হাজার।

যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্য দুর্যোগপূর্ণ ঘোষণা : বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্যে দুর্যোগ ঘোষণা করেছে দেশটির ফেডারেল সরকার। স্থানীয় সময় গত শনিবার করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে ওয়াইওমিং অঙ্গরাজ্যে দুর্যোগ ঘোষণা করার বিষয়টি অনুমোদন করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মাধ্যমে দেশটির প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্য একসঙ্গে ফেডারেল দুর্যোগ ঘোষণার আওতাভুক্ত হয় বলে সিএনএন জানিয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে  হোয়াইট হাউস এই নিয়ে ৫৫টি দুর্যোগ ঘোষণা দিল বলে জানিয়েছে তারা। এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সব, পাশাপাশি ইউএস ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, নর্দার্ন মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ, ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া, গুয়াম ও পুয়ের্তো রিকোসহ  দেশটির সব অঞ্চল ফেডারেল দুর্যোগ ঘোষণার আওতাভুক্ত হলো।

ব্রিটেনে ২৪ ঘণ্টায় ৯১৭ মৃত্যু : যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শনিবার বিকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ব্রিটেনে ৯১৭ জন মৃত্যুবরণ করেছে। মৃতদের বয়স ১১ থেকে ১০২ বছরের মধ্যে ছিল এবং ৩৩ জনের পূর্ব কোনো রোগ ছিল না। ইংল্যান্ডের মধ্যে শুধু লন্ডনে মৃত্যুবরণ করে ২০৮ জন, নর্থ ওয়েস্ট ইংল্যান্ডে ১৯৭ জন এবং মিডল্যান্ডে ১৬৫ জন। স্কটল্যান্ডে ৪৭ জন মারা  গেছে। এ নিয়ে স্কটল্যান্ডে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৫৪২। উত্তর আয়ারল্যান্ডে আরও ১৫ জন করোনাভাইরাসজনিত মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এনিয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১০৭।

এদিকে আরও জানা গেছে, যুক্তরাজ্যের ক্রয়ডন বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ছিল অস্থি সংক্রান্ত চিকিৎসার জন্য নির্মিত। কিন্তু দেশটিতে করোনাভাইরাস মহামারী রূপ ধারণ করায় এটিকেও কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে ভয়াবহ এক পরিস্থিতিকে। তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে তাতে তারা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। সেখানে চিকিৎসকদের এখনো পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দেয়া হয়নি। রোগীদের অনেককেই এখনো আইসিইউতে ভর্তি করা যায়নি। অনেকেই আছেন যাদের  ভেন্টিলেটর দেওয়া যাচ্ছে না। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই  রোগীদের চিকিৎসা দিতে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসকরা।

অনির্দিষ্টকালের কারফিউয়ে সৌদি আরব : করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় সৌদি আরবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দেশটিতে কারফিউ চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল-সৌদ। সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে, রাজ্যের সব শহর, গভর্নরেট ও আবাসিক এলাকায় পূর্বঘোষিত সতর্কতামূলক নিষেধাজ্ঞাগুলোর সময় বাড়ানো হয়েছে। এর আগে, গত ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ২১ দিনের কারফিউ জারি করেছিল সৌদি প্রশাসন। গত সপ্তাহে রাজধানী রিয়াদ, মক্কাসহ অন্য বড় শহরগুলোতে দিনরাত ২৪ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়। এবার সেসব নির্দেশনা পরবর্তী আদেশ না  দেওয়া পর্যন্ত জারি থাকবে বলে জানিয়েছেন সৌদি বাদশাহ। সৌদি আরবে রাজপরিবারের লোকজনসহ এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৪ হাজার ৩৩ জনের শরীরে। মারা গেছে ৫২ জন।

জাপানের পরিস্থিতিও ভয়ঙ্কর : আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে এশিয়ার অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র জাপানও। করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে পারছে না জাপান। টানা চতুর্থ দিন আক্রান্তের সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে বেড়েছে। জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, শনিবার নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৭১৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছে চারজনের। জাপানে সর্বমোট আক্রান্ত ৭ হাজার ৪৬০ জন। এর মধ্যে দেশটিতে নোঙর করা ডায়মন্ড প্রিন্সেস প্রমোদতরীর ৭১২ জন আছে। ওই জাহাজের ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে, সুস্থ ৬১৯ জন। দেশটিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা ১০৯। টোকিওতে শনিবার রেকর্ড ১৯৭ জনের কভিড-১৯ ধরা পড়েছে, মোট এ সংখ্যা ১ হাজার ৯০২ জন। এদিকে জাপানের জনগণকে কোয়ারেন্টাইনে উদ্বুদ্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে টুইটারে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। সোফায় বসে কুকুরকে আদর করতে ও বই পড়তে দেখা গেছে তাকে। সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ করে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পারছি না এবং কোনো দাওয়াতেও যাচ্ছি না। কিন্তু এসব অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করছে।’

বিশ্বে ৬০ লাখ নার্সের সংকট : সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা চিকিৎসার জন্য বিশ্বে ৬০ লাখ নার্সের সংকট তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংকট রয়েছে আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলোতে। ডব্লিউএইচওর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. টেড্রোস আধানম গ্যাব্রিয়াসিস বলেন, যে কোনো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মেরুদ- হলেন নার্স। কভিড-১৯ মহামারীতে অনেক নার্স সামনে থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে নার্সের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৪৭ লাখ হয়েছে। তাদের ৮০ শতাংশের বেশি কাজ করেন ওইসব দেশে, যেখানে বিশ্বের অর্ধেক মানুষের বাস। বিশ্বে প্রতি পাঁচজনে একজন নার্স যে দেশ জন্ম নিয়েছেন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন তার বাইরের কোনো দেশে কাজ করেন।

আগামী ১০ বছরের মধ্যে প্রতি ছয়জনে একজন নার্স অবসর নেবেন। বিশ্বের ৯০ শতাংশ নার্স নারী এবং তাদের হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র হাসপাতালে জ্যেষ্ঠ পদে আছেন। ফলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরার কেউ নেই।

ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নার্সরা যখন নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পাবেন- উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যখন সরকার ব্যবস্থায় একজন প্রধান নার্সিং কর্মকর্তা থাকবেন তখন তাদের অবস্থার উন্নতি হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর