সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

সমন্বয়হীনতা সবখানে

কেউ বলছে কারখানা খোলা কেউ বলছে বন্ধ, কেউ বলছে অফিস খোলা কেউ বলছে বন্ধ, পুলিশ র‌্যাব করছে জরিমানা চিকিৎসাসেবা নিয়েও রয়েছে সমন্বয়ের অভাব মন্ত্রণালয় অধিদফতরের রয়েছে গ্যাপ, অন্য মন্ত্রণালয়েও একই চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সবখানেই  দেখা যাচ্ছে সমন্বয়হীনতা। মহামারী ঠেকাতে যানবাহন ও অফিস-আদালত বন্ধ করে সারা দেশকে একধরনের লকডাউনের মধ্যে রাখা হলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। পোশাক মালিকদের কারখানা খোলা বন্ধ নিয়েও চলছে নানান লুকোচুরি। কেউ বলছে বন্ধ, কেউ বলছে বিশেষ ব্যবস্থায় কারখানা খোলা। অফিস আদালতের ক্ষেত্রেও একেক সময় আসছে একেক ধরনের নির্দেশনা। সমন্বয় নেই চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মধ্যেও বড় ধরনের গ্যাপ। কাগজে কলমে প্রস্তুত দেখানো হলেও ঢাকার বড় দুই হাসপাতাল এখনো রোগী নেওয়ার মতো অবস্থায়ই যায়নি। একই অবস্থা অন্যান্য ক্ষেত্রেও। সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই চলছে ত্রাণ বিতরণ এবং ওএমএস চাল বিক্রি। এরই মধ্যে বেতন ভাতার দাবিতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ উদ্বিগ্ন করেছে সবাইকে।

জানা যায়, করোনাভাইরাসের কারণে প্রথম দফায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হয়েছিল। এরপর ছুটি বাড়িয়ে তা ১১ এপ্রিল করা হয়। ছুটি তৃতীয় দফা বাড়িয়ে করা হয় ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সর্বশেষ ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এই ছুটি সাধারণ ছুটির মতো বিবেচিত হবে না উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে কয়েকটি শর্ত দিয়ে সেগুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রশমনে জনগণকে অবশ্যই ঘরে অবস্থান করতে হবে। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হতে অনুরোধ করা হয়েছে। সন্ধ্যা ছয়টার পর কেউ বাড়ির বাইরে বের হতে পারবেন না। এই নির্দেশ অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় চলাচল কঠোরভাবে সীমিত থাকবে। তবে বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করার কথা বলা হয় প্রজ্ঞাপনে। এতে আরও বলা হয়, জরুরি প্রয়োজনে অফিসগুলো খোলা রাখা যাবে। প্রয়োজনে ওষুধ শিল্প, উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা চালু রাখা যাবে বলে উল্লেখ করা হয় সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এর আগে এমন নির্দেশনা  পেয়েই কিছু কারখানা প্রথম দফায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণার পর আবার কারখানা চালুর উদ্যোগ নেয়। ফলে কর্মস্থল ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া শ্রমিকরা লকডাউন অবস্থাতেও বাধ্য হয়ে হেঁটে শত শত কিলোমিটার দূরের গন্তব্য থেকে কর্মস্থলে রওনা হন। এই দৃশ্য দেখে সারা দেশে সরকার ও পোশাক মালিকদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও কিছু পোশাক কারখানা চালু থাকায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে যাচ্ছে।  গতকালও ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহ এলাকায় কিছু কারখানা চালু ছিল।

বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ শুরু থেকেই বলে আসছে কারখানা বন্ধ ঘোষণার এখতিয়ার তাদের নেই। তারা কারখানার মালিকদের বন্ধ রাখার অনুরোধ জানাতে পারেন। কারখানার মালিক ও সরকার চাইলে কারখানা বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু সরকার শুরু থেকেই কারখানা বন্ধের বিষয়টি মালিকদের ওপর ছেড়ে দেয়। পোশাক কারখানা মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইতিমধ্যে বিপুল অঙ্কের অর্ডার বাতিল হয়েছে। আরও বেশকিছু ক্রেতা তাদের অর্ডার বাতিল করতে পারে বলে জানানো হয়। সার্বিক অবস্থার স্বার্থে তৈরি পেশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখা প্রয়োজন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে পিপিই, মাস্ক তৈরির অনেক অর্ডার রয়েছে সেগুলোও মানবিক কারণে দ্রুত সরবরাহ করতে হবে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জরুরি রপ্তানির স্বার্থে ছুটি শেষে সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো খোলার কথা বলেন। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত সচিব) শিবনাথ রায় স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় বলা হয়, বিভিন্ন কলকারখানা বন্ধ করার বিষয়ে কিছু প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিভিন্ন বক্তব্য ও তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে। এতে কারখানা মালিক শিল্প কলকারখানা চালু রাখার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। যেসব রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ বহাল রয়েছে এবং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জরুরি অপরিহার্য পণ্য যেমন-পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট, মাস্ক, হ্যান্ড ওয়াশ/স্যানিটাইজার, ওষুধপত্র ইত্যাদি কার্যক্রম চলমান রয়েছে, সেসব কলকারখানা বন্ধ করার বিষয়ে সরকার কোনো নির্দেশনা দেয়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং আইইডিসিআর কর্তৃক জারিকৃত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নির্দেশিকা কঠোরভাবে প্রতিপালন সাপেক্ষে মালিকরা প্রয়োজন বোধে কলকারখানা সচল রাখতে পারবেন।

অন্যদিকে, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একের পর এক প্রজ্ঞাপন বা আদেশ জারির পর সংশোধন প্রত্যাহার করার ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ জনপ্রশাসনের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রজ্ঞাপনেও সংশোধন আনতে হয়েছে। আগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সন্ধ্যা ৬টার পর কেউ ঘরের বাইরে বের হতে পারবেন না। এই নির্দেশ অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা কোন সময় পর্যন্ত বহাল থাকবে তা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল না। পরে সংশোধিত প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কেউ ঘরের বাইরে বের হতে পারবেন না। এই নির্দেশ অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ এর আগে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা  দেওয়া নিয়ে সম্মুখ যোদ্ধা ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে দুই দফায় অযৌক্তিক প্রজ্ঞাপন ও নির্দেশনা জারি করে পরে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। করোনা যুদ্ধের আরেক সম্মুখ যোদ্ধা গণমাধ্যমের ওপর নজরদারি নিয়েও প্রজ্ঞাপন জারি করে বিতর্ক তৈরি করেছিল সরকারের আরেকটি মন্ত্রণালয়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় মনোযোগ এবং প্রস্তুতির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। করোনা পরিস্থিতির প্রাথমিক স্তর শেষ করে এসেছি মনোযোগ ছাড়াই। এখন পরের ধাপ। চলাফেরায় বিধি-নিষেধ বা এক প্রকার লকডাউন চলছে। অন্যরা এটি অনেক আগেই করেছে। আমরা করলাম পরে। তার মানে গুরুত্ব উপলব্ধির ঘাটতিটা এখনো রয়ে গেছে। বিভিন্ন মহল থেকে করোনা নিয়ে যে তথ্য আসছে, তা ঠিক গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়নি। তিনি বলেন, করোনা সফলভাবে মোকাবিলা করতে হলে জনগণ, সামাজিক শক্তি, সরকার, রাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করে একত্র হয়ে কাজ করা জরুরি। যারাই একত্র হয়ে কাজ করেছে, তারাই করোনা মোকাবিলায় আপাতত সফল হয়েছে। কোথাও রাষ্ট্র নেতৃত্ব দিয়েছে, কোথাও ব্যক্তি বা সামাজিক শক্তিগুলো নেতৃত্ব দিয়েছে। আস্থার ঘাটতিটা এখনো তীব্র বাংলাদেশে।

সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোথায় কোথায় যেন সমন্বয়হীনতা। দেশের সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকদের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হলো। অবস্থার উন্নতি না হওয়া সত্ত্বেও তাদের যোগদানের কথা বলা হলো। এটা কীভাবে হয়? এটা অমানবিক কাজ হয়েছে। শ্রমিকদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেওয়ার আগে তারা সরকারের সঙ্গে কথা বলে নিতে পারত। হয় তারা তা করেনি অথবা তারা সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করেছে।  এমনিতেই বিপুলসংখ্যক মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব সমন্বয়হীনতা যত দ্রুত দূর হবে ততই মঙ্গল। তা না হলে বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়তে পারে দেশ।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর