মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

থমকে আছে রমনা বটমূলের সেই বোমা হামলার বিচার

আরাফাত মুন্না

১৯ বছর আগে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রাজধানীর রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান নয়জন। হাসপাতালে আরও একজন মারা যান। নির্মম এ ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার বিচারকাজ থমকে আছে। হত্যা মামলায় ২০১৪ সালে বিচারিক রায় দিলেও আসামিপক্ষের আপিল ও রাষ্ট্রপক্ষের করা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড নিশ্চিতকরণ) আবেদন হাই কোর্টে ঝুলছে ছয় বছর ধরে। অন্যদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলার বিচারকাজ এগোচ্ছে না সাক্ষীর অভাবে। এ ছাড়া পলাতক চার আসামির হদিসও মেলেনি এত বছরে। এ কারণে বিচার শেষ হওয়া নিয়ে উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ছে সংশ্লিষ্টদের।

দীর্ঘদিনেও বিচার শেষ না হওয়ায় ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু আক্ষেপ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চোখের সামনে মানুষ মারা গেল, রক্তে ভিজে গেল আমার গায়ের পোশাক, সেই ঘটনার বিচার আজও দেখতে পারলাম না, এটাই আফসোস।’ এ মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তা এবং বিচারককে আরও বেশি তৎপর হতে হবে মন্তব্য তার।

মামলার নথিসূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার তৎকালীন দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রুহুল আমিন বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয় ছয় আসামিকে। মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ডও দিয়েছে আদালত। এ মামলায় ১৪ আসামির মধ্যে চারজন শুরু থেকেই পলাতক। বাকিরা বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। এসব আসামির মধ্যে সিলেটে ২০০৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলায় তিনজন নিহত হওয়ার মামলায় ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে মুফতি হান্নানের। পলাতক আসামিরা হলেন মাওলানা মো. তাজউদ্দিন আহমদ, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান শফিক ও মুফতি আবদুল হাই।

বিচারিক আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করেছেন আসামিরা এবং তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকরে ডেথ রেফারেন্স আবেদনও করেছে রাষ্ট্রপক্ষ, যা ছয় বছর ধরে হাই কোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানিয়েছে, হত্যা মামলার পেপারবুক তৈরির পর ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি হাই কোর্টের একটি বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। কিন্তু পরে ওই বেঞ্চটি পুনর্গঠিত হলে মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ পড়ে। তবে দীর্ঘদিন পর আলোচিত এ হত্যা মামলাটি সম্প্রতি বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চের কার্যতালিকায় শুনানির জন্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মামলাটি আমাদের বেঞ্চের কার্যতালিকায় আছে। আদালত খোলার পর আশা করি দ্রুতই আপিল ও ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হবে।’

দীর্ঘদিনের উচ্চ আদালতে আপিল ও ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একাধিকবার বেঞ্চ বদলের ফলে আপিল ও ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তিতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আদালত খোলার পর এই আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

অন্যদিকে বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের মামলাটির বিচার চলছে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। ২০০৯ সালে এ মামলায় অভিযোগ গঠনের পর প্রথম সাতজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এরপর এ মামলার বিচারকাজ দীর্ঘদিন থমকে ছিল শুধু সাক্ষীর অভাবে। গত বছর থেকে কিছুটা গতি এসেছে মামলায়। মামলার মোট ৮৪ সাক্ষীর মধ্যে এখনো পর্যন্ত ৫২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরেই এ মামলায় ২৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সর্বশেষ ২০ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবু আবদুল্লা ভূঁইয়া। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর আদালত পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়ে নতুন করে দিন ঠিক করবে।’

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘ইসলামবিরোধী’ বিবেচনা করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। এ ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। ঘটনার প্রায় আট বছর পর ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আলোচিত এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা বারবার পরিবর্তন, সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসার কারণে বিচার শুরু হতে দেরি হয়। পর্যায়ক্রমে থানা, ডিবি ও সিআইডি পুলিশে মামলার তদন্ত যায়। মামলার অষ্টম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দুটি মামলারই অভিযোগপত্র একসঙ্গে দাখিল করা হয়। পরে বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়। ওই আদালতে একই বছরের ১৬ এপ্রিল পৃথক মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠানো হয়।

সর্বশেষ খবর