শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

বিশ্বে মৃত্যুর মিছিলে দেড় লাখ

যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছে ৩৪ হাজার ৭০৫ জন, চীনে এক দিনেই গেল ১২৯০ প্রাণ

প্রতিদিন ডেস্ক

বিশ্বে মৃত্যুর মিছিলে দেড় লাখ

মহামারী করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ২২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মৃতের মিছিলে যুক্ত হয়েছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ। আর এই মিছিলে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটিতে গতকাল রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ৩৫ হাজার ৩৭১ জন লোক মারা গেছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার চীনে এক দিনেই সর্বাধিক ১২৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর যুক্তরাজ্যে মারা গেছেন ৮৪৭ জন। তবে সুখবর হচ্ছে- ইতালি ও ফ্রান্সে কেউ মারা যাননি। এমনকি এসব দেশে নতুন করে কেউ আক্রান্তও হননি। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এখনো ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো চষে বেড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। করোনা আক্রান্ত ২২ লাখের মধ্যে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ এই অঞ্চলের। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আক্রান্তের প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ। তবে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর কয়েকটিতে করোনা আক্রান্তের হার কয়েক দিন কমে আবার বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া ইউরোপের অন্য দেশগুলোতেও হার বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আশঙ্কা আফ্রিকায় করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কোটিতে পৌঁছাতে পারে। সংস্থার মতে, আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কোটিতে পৌঁছাতে পারে। এক অস্থায়ী নমুনায়নে আক্রান্তের এই হার উঠে আসার কথা জানিয়েছেন সংস্থাটির এক আঞ্চলিক কর্মকর্তা। তবে অভ্যাসে বদল আনার মধ্য দিয়ে এই সংখ্যায় বদল আনা সম্ভব বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি। আফ্রিকা মহাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে সেখানকার ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চাপ সামলাতে পারবে না বলে আশঙ্কা রয়েছে। আফ্রিকা অঞ্চলের ডব্লিউএইচও পরিচালক মাতশিদিসো মোয়েতি বলেন, ‘ভাইরাসটি বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভৌগোলিক দিক থেকে পরিবর্তিত হতে থাকায় আমরা আতঙ্কিত। আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।’ এখন পর্যন্ত আফ্রিকায় করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। বুরকিনা ফাসো, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক কঙ্গো ও আলজেরিয়ার মতো দেশগুলোতে গড় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনে শুরু হয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এরপর এটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ৬৭ দিনের মাথায় ১ লাখ লোকের করোনা শনাক্ত হয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর মার্চের শেষ দিকে আক্রান্তের হার বাড়তে শুরু করে। তিন মাসের মাথায় ৩১ মার্চ ৮ লাখ ছাড়ায় করোনা শনাক্তের সংখ্যা। আর এপ্রিলের ১৫ দিনেই করোনা শনাক্ত হয়েছে প্রায় ১২ লাখ। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রথম ১০ লাখ পর্যন্ত ৫২ শতাংশ রোগী ছিল ইউরোপের। ২০ লাখ পার হওয়ার পর এটি কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে। এর মধ্যে বেড়ে গেছে উত্তর আমেরিকায়। এই অঞ্চলে ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে রোগীর সংখ্যা। এ দুই মহাদেশ মিলিয়েই রোগী রয়েছে ৭৯ শতাংশের বেশি। এশিয়ায় আক্রান্তের হার আগের চেয়ে কমেছে। ২০ থেকে এটি ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাড়তে শুরু করেছে। প্রথম ১০ লাখে দক্ষিণ এশিয়ায় রোগী ছিল ১ শতাংশের অর্ধেকের কম। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আক্রান্ত বেড়ে যাওয়ায় এখন এটি ১ শতাংশ পার করেছে। তবে সবচেয়ে উন্নতি হয়েছে ওশেনিয়া বা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে।

আক্রান্ত শীর্ষ দেশগুলোয় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সব দেশেই এক থেকে দেড় মাস পরে বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে করোনার। ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, ২৯ জানুয়ারি ইতালি, ৩০ জানুয়ারি স্পেন, ২৬ জানুয়ারি জার্মানি ও ২৩ জানুয়ারি ফ্রান্সে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তবে দেশগুলোয় করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে মার্চে। যুক্তরাষ্ট্রে ৬ লাখ ছাড়িয়েছে। ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্সও লাখের ঘর পার করেছে। এ দেশগুলোতে এখন শনাক্তের হার কমছে। তবে লাখ ছুঁই ছুঁই যুক্তরাজ্যে এখনো বাড়ছে আক্রান্তের হার।

প্রায় একই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় আঘাত হানে করোনা। ২৩ জানুয়ারি প্রথম করোনা-আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করে নেপাল। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ৩০ জন। ২৬ জানুয়ারি করোনা শনাক্ত হয় শ্রীলঙ্কায়। এখন সেখানে রোগীর সংখ্যা ২৪২। ২৯ জানুয়ারি ভারত, ২৩ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান, ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান, ৫ মার্চ ভুটান, ৬ মার্চ মালদ্বীপ ও সর্বশেষ ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়।

করোনা শনাক্তের শুরুতেই লকডাউন ঘোষণা করে নেপাল ও ভুটান। এর ফল পেয়েছে দেশ দুটি। ভুটানে আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র পাঁচজন। একটু দেরিতে হলেও লকডাউন ঘোষণা করে অনেকটা প্রতিরোধ করেছে মালদ্বীপ। দেশটিতে শনাক্ত হয়েছেন ২৮ জন। এ তিনটি দেশে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেউ মারা যাননি। তবে ভাইরাস প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে আলোচিত লকডাউনের মতো সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় কিছুটা বিপাকে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলো। এ কারণেই পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে সংক্রমিত হয়েছেন রোগীরা। গতকাল রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে ভারতে ১২ হাজার ৪৫৬, পাকিস্তানে ৬ হাজার ৫০৫, আফগানিস্তানে ৭৮৪ ও বাংলাদেশে ১ হাজার ৫৭২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু দিন ধরে সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশে। বাড়া-কমার মধ্যেই শীর্ষ ১০ দেশ : জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তথ্য মতে, মাত্র ১০টি দেশে রয়েছে ৭৮ শতাংশ করোনা রোগী। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইরান, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক ও বেলজিয়াম। প্রথম ১০ লাখ রোগীর মধ্যে শীর্ষ দশে সুইজারল্যান্ড থাকলেও দেশটি বেরিয়ে গেছে এখন। তাদের বদলে শীর্ষ ১০ আক্রান্তের তালিকায় ঢুকেছে বেলজিয়াম।

শিগগিরই ইউরোপ ছাড়ছে না করোনা : ইউরোপের ৪৬টি দেশে করোনা ছড়িয়েছে। এগুলোর মধ্যে করোনা আক্রান্ত শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে রয়েছে ১২টি।

সবচেয়ে বেশি করোনা শনাক্ত হয়েছে স্পেনে। গতকাল পর্যন্ত পাওয়া গেছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৯৪৮ জন। শীর্ষ দশে থাকা দেশগুলো ছাড়াও রাশিয়া, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, সার্বিয়া, পোল্যান্ড, ডেনমার্কে নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শীতপ্রধান অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ইউরোপের দেশগুলো থেকে তাই শিগগিরই করোনা মুক্তির আভাস মিলছে না। এখন পর্যন্ত ৯ লাখ ৫৯ হাজার আক্রান্ত হওয়ায় ইউরোপে মারা গেছেন প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ।

সব ছাপিয়ে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র : উত্তর আমেরিকায় করোনা শনাক্ত হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৮৪ হাজার। এর মধ্যে ৬ লাখ ৭৯ হাজার রোগী শুধু যুক্তরাষ্ট্রে। আর কানাডায় আছে ৩০ হাজারের বেশি। এই দুটি দেশ বাদ দিলে এই অঞ্চলের ২২টি দেশের মধ্যে মেক্সিকো, পানামা ও ডমিনিকান রিপাবলিক ছাড়া আর কোনো দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা হাজার পার হয়নি। শুধু আক্রান্তের দিক থেকেই নয়, মৃত্যুর দিক থেকেও সবার ওপরে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে গতকাল রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ।

তবে এমআইটির গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরের দিকের রাজ্যগুলোর তাপমাত্রা কম এবং সেখানে সংক্রমণের হার অপেক্ষাকৃত উষ্ণ দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর তুলনায় বেশি। তাই ইতিমধ্যেই কিছু রাজ্যের লকডাউন খুলে দিতে শুরু করেছে দেশটির সরকার। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের সর্বোচ্চ পর্যায় পার করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।

দক্ষিণ আমেরিকায় বাড়ছে ব্রাজিলে : করোনা শনাক্ত বাড়তে শুরু করেছে দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে। বিশ্বের ৩ শতাংশ রোগী আছে এই অঞ্চলে। যদিও প্রথম ১০ লাখের মধ্যে ছিল ২ শতাংশ। এই অঞ্চলের ১৫টি দেশে ছড়িয়েছে করোনা, এগুলোর মধ্যে ৯টি দেশে নিয়ন্ত্রণেই আছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্রাজিলে। দেশটিতে ইতিমধ্যেই আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ২৮ হাজার। এ ছাড়া চিলি, পেরু, ইকুয়েডরেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ভাইরাসটির সংক্রমণ। করোনা মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিয়ে বরখাস্ত হলেন ব্রাজিলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী লুইজ হেনরিক মানদেত্তা।

এশিয়ায় কমেছে আক্রান্তের হার : ভাইরাসটির জন্ম এশিয়ার চীনে। তবে এই অঞ্চলে আক্রান্তের হার কমে এসেছে। প্রথম ১০ লাখে এশিয়ায় রোগী ছিল ২০ শতাংশ। ২০ লাখ পার হওয়ার পর এটি ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে গতকাল চীনে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। এর আগে ২০ শতাংশের মধ্যে চীনের রোগী ছিল ৮ শতাংশ। এখন এটি কমে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েলসহ বেশির ভাগ দেশ ভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। শঙ্কা তৈরি করছে নতুন করে বাড়তে থাকা কয়েকটি দেশ। এগুলোর মধ্যে এশিয়ায় এখন সবচেয়ে বেশি নতুন রোগী ইরান ও তুরস্কে। এর বাইরে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। তিনটি দেশেই বাড়ছে আক্রান্তের হার।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর