মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

সমন্বয়হীনতা কাটাতে চায় সরকার

৬৪ জেলায় ৬৪ সচিবকে দায়িত্ব, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা ও যাতায়াতের ব্যবস্থা নিতে ডিসি সিভিল সার্জনদের নির্দেশ, মানসম্মত চিকিৎসা সামগ্রী বণ্টনে নজরদারি

নিজামুল হক বিপুল

সমন্বয়হীনতা কাটাতে চায় সরকার

দেশে করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ১০০। আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। মানুষকে ঘরে থাকার অনুরোধ জানিয়ে এবং লকডাউন করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পরিস্থিতির শুরু থেকেই সমন্বয়হীনতার অভিযোগ রয়েছে। অবস্থা সামাল দিতে সরকার সমন্বয়হীনতা কাটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইতিমধ্যে প্রতি জেলায় একজন করে দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪ সচিবকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়া, যাতায়াতসহ সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে। জেলা শহরে অবস্থিত হোটেল ও আবাসিক ভবন রিকুইজিশন করতে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই, মাস্কসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করতে। সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং বা তদারকি করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নির্দেশনা পাওয়ার পর পরই জেলা শহরগুলোয় হোটেল রিকুইজিশনের কাজ শুরু করেছেন জেলা প্রশাসকরা। আবার কোনো কোনো জেলায় ডিসিরা আগে থেকেই হোটেল রিকুইজিশনের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিবহনের জন্য যানবাহন; রোগীদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স; পর্যাপ্তসংখ্যক পিপিই, ওষুধ, ভেনটিলেটর ও লাশ পরিবহনের জন্য ব্যাগ প্রভৃতি প্রস্তুত রাখতে।

সরকারের এ উদ্যোগকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘দেরিতে হলেও এটি খুবই সময়োপযোগী হয়েছে। এটি একটি সঠিক ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। আরও আগে নিলে ভালো হতো। তার পরও এখন যেহেতু নেওয়া হয়েছে সেহেতু আমি মনে করি, এটি খুবই কাজে আসবে।’ তিনি বলেন, সরকারের উচিত হবে তাদের দিকে বেশি নজর দেওয়া যারা কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত অর্থাৎ চিকিৎসক থেকে শুরু করে নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এমনকি পরিচ্ছন্নতাকর্মী পর্যন্ত, তাদের প্রত্যেককে পিপিইসহ সব ধরনের ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করতে হবে বেশি সংখ্যায় যাতে তারা কখনো আটকে না যান। তিনি আরও বলেন, ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছ হতে হবে। কেউ যেন না খেয়ে থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, এ সংকট মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও আইসোলেশনে থাকা। কিন্তু তা হচ্ছে না। এটা করতে না পারলে এ সমস্যা সহসা কেটে যাবে বলে মনে হয় না। পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে করোনাভাইরাস নিয়ে দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলে আসা সমন্বয়হীনতা দূর করার। শুরু থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হচ্ছিল করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর গার্মেন্ট সেক্টরে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তাতেও সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়ে হয়ে ওঠে।

গত দুই দিনে একাধিক নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর অন্যতম হচ্ছে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও জেলা পর্যায়ে চলমান ত্রাণ কার্যক্রম সুসমন্বয়ের লক্ষ্যে সিনিয়র সচিব, সচিব এবং সচিব পদমর্যাদার ৬৪ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব বণ্টন। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত একটি করে জেলার সামগ্রিক কার্যক্রম সমন্বয় করবেন। এ বিষয়ে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ জারি হয়েছে।

আদেশে বলা হয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা জেলার সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করে কভিড-১৯-সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার কাজ তত্ত্বাবধান ও পরিবীক্ষণ করবেন।

জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পরিবীক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় করতেও সচিবদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্যা/চ্যালেঞ্জ অথবা অন্যবিধ বিষয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, সংস্থাকে লিখিত আকারে জানাবেন এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে নিয়মিত অবহিত করবেন।

এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সারা দেশে রবিবার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও সিভিল সার্জনদের চিঠি দিয়েছে কভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য।

চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশেষভাবে উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য সুরক্ষা তথা সঙ্গনিরোধ নিশ্চিতকরণের অনিবার্য প্রয়োজনে পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে নিজ বাসস্থানে অবস্থান করে চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত থাকা সমীচীন হবে না। তাই তাদের জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ভিন্ন কোনো স্থানে অবস্থানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

এসব অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কী করতে হবে সে বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজন ও উপযোগিতা বিবেচনায় হোটেল বা ভবনের সংখ্যা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। অধিগ্রহণ করা হোটেল বা ভবনের ইউটিলিটি বিল এবং সেখানে অবস্থানরতদের নির্ধারিত হারে খাওয়া খরচও সরকার বহন করবে। হোটেল বা ভবন কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সহায়ক জনবল ও অন্যান্য সার্বিক সহযোগিতা দিতে হবে।

একই নির্দেশনায় জেলা সিভিল সার্জনদের বলা হয়েছে, করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক হাসপাতাল বা কেন্দ্র; চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিবহনের জন্য যানবাহন; রোগীদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স; চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক পিপিই, ওষুধ ও ভেনটিলেটর এবং লাশ পরিবহনের জন্য ব্যাগ প্রভৃতি প্রস্তুত রাখা জরুরি। এ বিষয়ে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে সিভিল সার্জনকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে বলা হয়েছে। এদিকে গতকাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি জেলায় হোটেল ও আবাসিক ভবন অধিগ্রহণের কাজ আংশিক হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব তপন কুমার বিশ্বাস। গতকাল তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইতিমধ্যে সারা দেশে অন্তত ২০টি জেলার ডিসিদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন তারা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। সরকারের নির্দেশনা পাওয়ার পর তাদের কাজ বেশ সহজ হয়ে যাবে।

অন্যদিকে ঢাকার জেলা প্রশাসক ব্যাপকভাবে তৎপরতা শুরু করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। সূত্রগুলো জানান, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি হোটেল বা আবাসিক ভবনের প্রয়োজন হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সহস্রাধিক চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর একটি তালিকা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে যারা অধিগ্রহণকৃত হোটেলে বা ভবনে থাকবেন। তবে ঢাকা জেলা প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনো হোটেল বা ভবন চূড়ান্তভাবে রিকুইজিশন করতে পারেনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর