মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

মৃত্যুর মিছিল থামছেই না বিশ্বে

ইউরোপ-আমেরিকার পর সর্বোচ্চ আক্রান্ত তুরস্কে

প্রতিদিন ডেস্ক

মৃত্যুর মিছিল থামছেই না বিশ্বে

মহামারী করোনাভাইরাসে বিশ্বজুড়ে প্রাণহানি এবং আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমলেও মৃত্যুর মিছিল থামেনি। প্রতিদিনই নতুন করে যোগ হচ্ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। এদিকে রবিবারের হিসাব অনুযায়ী, ইউরোপ ও আমেরিকার পর করোনায় সর্বোচ্চ আক্রান্তের তালিকায় ছিল তুরস্ক।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্যানুযায়ী, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে প্রাণহানি অনেকটা কমেছে। গত তিন দিনে মৃতের সংখ্যা দেড় লাখ থেকে পৌনে দুই লাখে পৌঁছাতে পারেনি। গতকাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭০ হাজারের নিচে। পাশাপাশি কয়েকদিনে ভাইরাসে আক্রান্তের গতিও তুলনামূলকভাবে কমেছে। গতকাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা ছিল অন্তত ৪১ হাজার এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ৬৫ হাজার। ইতালিতে মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪ হাজার এবং আক্রান্ত ১ লাখ ৭৯ হাজার, স্পেনে মৃতের সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার এবং আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখের বেশি, ফ্রান্সে মৃতের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার এবং আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫৩ হাজার, যুক্তরাজ্যে মৃতের সংখ্যা ১৬ হাজারের বেশি এবং আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার। এ ছাড়া বেশি আক্রান্ত অন্য দেশগুলোর মধ্যে বেলজিয়াম, ইরান, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসে মৃত্যের মোট সংখ্যা ছিল ৪ থেকে ৬ হাজারের মধ্যে।

ইউরোপ-আমেরিকার পর সর্বোচ্চ আক্রান্ত তুরস্কে : তুরস্কে মহামারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল গত রবিবার পর্যন্ত ৮৬ হাজার ৩০৬ জন। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহরেতিন কোকা এ তথ্য দেন। সেই হিসাবে ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে তুরস্কেই সবচেয়ে বেশি মানুষ এখন করোনায় আক্রান্ত। চীনে আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৮২ হাজারের বেশি। রয়টার্সের প্রতিবেদনে তুর্কি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, তুরস্কে রবিবার ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনাভাইরাস সংক্রমিত কভিড-১৯ রোগী হিসেবে শনাক্ত হন ৩ হাজার ৯৭৭ জন। আর এর মধ্য দিয়েই তুরস্ক আক্রান্তের দিক দিয়ে করোনার উৎপত্তিস্থল চীনকে ছাড়িয়ে যায়। তুর্কি স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোকা বলেন, একদিনে আরও ১২৭ জন করোনা রোগী প্রাণ হারিয়েছেন। এ নিয়ে সরকারি হিসাবে দেশটিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা এখন ২ হাজার ১৭ জন। তবে আক্রান্ত ৮৬ হাজারের বেশি।

প্রসঙ্গত, ইউরোপ-এশিয়ার মাঝামাঝি অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ তুরস্কে গত ১০ মার্চ প্রথমবারের মতো করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। কিন্তু তারপর থেকেই দেশটিতে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়তে শুরু করে। বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যায় তুর্কির অবস্থান সপ্তম।

ইতালিতে এক সপ্তাহে সবচেয়ে কম মৃত্যু রেকর্ড : রয়টার্স জানিয়েছে, ইতালিতে ধীরে ধীরে কমে আসছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। তবে এখনো থামেনি মৃত্যুর মিছিল। গত শনিবার দেশটিতে করোনায় প্রাণ হারান ৪৩৩ জন, যা গত এক সপ্তাহের মধ্যে সর্বনিম্ন। কমেছে আক্রান্তের হারও। রবিবার ইতালির সিভিল প্রটেকশন এজেন্সি জানিয়েছে, দেশটিতে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৭ জন, যা আগের দিনের চেয়ে বেশ কম। শনিবার ৩ হাজার ৪৯১ জনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ার কথা জানিয়েছিল ইতালি কর্তৃপক্ষ। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, ইতালিতে রবিবার পর্যন্ত করোনায় মারা যান ২৩ হাজার ৬৬০ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৭২ জন। দেশটিতে এখনো করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল উত্তরাঞ্চলীয় লোম্বার্দি, বাণিজ্যিক রাজধানী মিলান, পিয়েদমৎ ও এমিলিয়া-রোমাগনা অঞ্চল। রবিবার নতুন করে ১৬৩ জনের মৃত্যু ও ৮৫৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন লোম্বার্দিতে।

সৌদি রাজপরিবারে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি : সৌদি আরবের রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা প্রথম প্রকাশিত পরিসংখ্যানের চেয়েও অনেক বেশি। এর আগে মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে প্রথম এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছিল এবং এতে সৌদি রাজপরিবারের আড়াইশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। সৌদির রাজা সালমানও করোনা মহামারী থেকে বাঁচতে জেদ্দার কাছে একটি দ্বীপ প্রাসাদে নির্জন জীবন-যাপনের পথ বেছে নিয়েছেন। রাজতান্ত্রিক দেশটির গোপন তথ্য ফাঁসকারী হিসেবে পরিচিত সৌদি নাগরিক আল-আহাদ আজ-জাদিদ এক টুইট বার্তায় বলেছেন, লোহিত সাগরের তীরবর্তী সৌদি বন্দরনগরী জেদ্দার একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করোনা আক্রান্ত রাজপরিবারের সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। এ হাসপাতাল করোনা রোগীতে পূর্ণ হয়ে গেছে এবং বর্তমানে সেখানে নতুন রোগী ভর্তি করার কোনো জায়গা নেই। টুইট বার্তায় আরও জানানো হয়, এ পরিস্থিতিতে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত রাজপরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য জেদ্দায় আরও দুই হোটেল নেওয়া হয়েছে। এ দুইয়ের মধ্যে একটি মুভেনপিক হোটেল বলেও বার্তায় উল্লেখ করা হয়। এদিকে গোপন তথ্য ফাঁসকারী আরেক সৌদি নাগরিক মুজতাহিদ অবশ্য রিয়াদ সরকারের করোনা সংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, সৌদি সরকার করোনা পরিস্থিতি নিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ করছে, দেশটির প্রকৃত পরিস্থিতি তার চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ।

আফগান প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে করোনার হানা : আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বেশ কয়েকজন কর্মীর শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রকে উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, অন্তত ২০ থেকে ৪০ জন কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি আফগান সরকার। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি নিজে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা সে ব্যাপারেও জানা যায়নি। জানা গেছে, করোনায় বিপর্যস্ত দেশ ইরান থেকে মার্চে কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষ ফিরেছেন আফগানিস্তানে। এতে আফগানদের মধ্যে সংক্রমণ দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত আফগানিস্তান সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেদেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৯৩৩ জন। মারা গেছেন ৩৩ জন। ধারণা করা হচ্ছে, আফগানিস্তানে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধের কারণে সেখানকার স্বাস্থ্যসেবার মানও বেশ নাজুক। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদেও করোনা হানা দিয়েছে। শনিবার আফগান সরকারের এক মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ২০ জন কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু বিষয়টিকে গোপন রাখা হয়েছে, যাতে এ নিয়ে কোনো আতঙ্ক ছড়িয়ে না পড়ে। এর পরদিন রবিবার নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৪০ জনে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৯০ এর দশকে ক্যান্সারে নিজের পাকস্থলীর কিছু অংশ হারিয়েছেন ৭০ বছর বয়সী আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। তার বর্তমান শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদ থেকে টুইটারে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায়, ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে সভাপতিত্ব করছেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ। এরপর ওই টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ইরানের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের বৈঠকের ছবি শেয়ার করা হয়েছে, তবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা হয়েছে এক্ষেত্রে।

করোনায় দ্বিতীয় দিনের মতো চীনে মৃত্যুশূন্য : চীনে গত শনি ও রবিবার করোনায় আক্রান্ত কোনো মানুষ মারা যাননি। প্রসঙ্গত, গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনার প্রকোপ দেখা দেয়। এরপর থেকেই উহানে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কয়েক মাসেই করোনা মহামারী পরিস্থিতি তৈরি করেছে। একই সঙ্গে উহানে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে। চীনে করোনায় আক্রান্ত ও মারা যাওয়াদের মধ্যে অধিকাংশই উহানের নাগরিক। তবে গত কয়েক মাসের প্রচেষ্টায় এরই মধ্যে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে চীন। তারা এই বিপর্যয় অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। অন্যান্য দেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও চীনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমতে শুরু করায় কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। এরই মধ্যে উহান থেকে লকডাউন তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে উহানে আটকা পড়া হাজার হাজার মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন।

এদিকে সবচেয়ে বড় সুখবর হচ্ছে গত শনি ও রবিবার চীনের কোথাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। নতুন করে করোনায় আক্রান্তের ঘটনা ঘটলেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশন জানিয়েছে, রবিবার নতুন করে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাননি। আগের দিনও করোনায় নতুন করে কারও মৃত্যু হয়নি। তবে রবিবার নতুন করে ১২ জন প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে আটজনই বহিরাগত। গত কয়েক সপ্তাহে স্থানীয়দের তুলনায় বহিরাগতদের আক্রান্তের হার বেশি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর