শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

রমজানে চ্যালেঞ্জ বাজার নিয়ন্ত্রণ

কারখানা বন্ধ থাকায় দেশি শিল্পে উৎপাদন বন্ধ, সীমিত ব্যাংকিংয়ে এলসির সমস্যা কনটেইনারজটে স্থবির চট্টগ্রাম বন্দর, পরিবহন সংকটে পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন, বাড়ছে ডলারের দাম, জনবলের অভাবে মনিটরিংয়ে দুর্বলতা, ভেজালমুক্ত পণ্য সরবরাহে ঘাটতি

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যেই আজ শুরু হচ্ছে রমজান মাস। আর এ মাসে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নিত্যপণ্য উৎপাদক, আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা এবং বাজার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রমজানে তারা অন্তত সাত ধরনের সংকট দেখছেন যেগুলো সরাসরি বাজার নিয়ন্ত্রণ, পণ্যমূল্য ও সরবরাহে আঘাত হানতে পারে। সংকটগুলো হচ্ছে- দেশি শিল্প বন্ধ থাকায় নিত্যপণ্যের উৎপাদন ব্যাহত; সীমিত ব্যাংকিং কার্যক্রমে এলসি করতে না পারা, ডলারের দাম বৃদ্ধি, দেশের প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারজট, পরিবহন সংকটে স্থানীয় পর্যায়ে পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন, জনবলের অভাবে মনিটরিংয়ে দুর্বলতা ও ভেজালমুক্ত পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরই মধ্যে উল্লিখিত সংকটগুলো প্রকট হতে শুরু করেছে এবং নিত্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তা, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা এসব বিষয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর ও সংস্থাগুলোকে অবহিত করেছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এসব সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন দফতরে চিঠি দিচ্ছে, ফোনে যোগাযোগ করছে। তবে এতেও আমদানি পণ্যের সরবরাহজনিত সংকট কাটেনি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. নাজনীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিবার রোজার সময় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সাময়িকভাবে দামও বেড়ে যায়। তবে তখন যেটি হয় সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় এক সপ্তাহের মধ্যে দাম আবার কমে যায়। করোনা সংকটের কারণে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশেষ করে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর সরবরাহজনিত সংকট দেখা দিয়েছে। লকডাউনের কারণে অন্য চ্যানেলগুলো বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ বেড়েছে। বেড়েছে কনটেইনারজট। এর ওপর পরিবহন সংকটও রয়েছে। এর ফলে পণ্যের সরবরাহজনিত যে সংকট তা রোজার মাসজুড়েই থাকতে পারে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে হোটেল ও ফুটপাথে ইফতার-সাহরি বিক্রি না হওয়ায় পণ্যের চাহিদা কিছুটা কম থাকবে। শেষ পর্যন্ত এ বিষয়টি দাম কমার ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বিআইডিএসের এই গবেষক।

সংশ্লিষ্টদের মতে, রোজায় আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ভেজালমুক্ত পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য এবার ইফতারিতে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করতে দিচ্ছে না পুলিশ। তবে ব্র্যান্ডের মোড়কজাত পণ্য নকল করে ভেজাল পণ্য বিক্রি থেমে নেই। শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রমজান মাসে ইফতার ও সাহরিতে ব্যবহৃত হয় এ রকম পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহের জন্য ধারাবাহিকভাবে তাগিদপত্র দেওয়া হয়েছে গত সপ্তাহে। পাশাপাশি বরাবরের মতো ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন, বিপণন এবং ওজন ও কারচুপি প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান পরিচালনার বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বিএসটিআইকে।

সূত্রগুলো জানান, করোনা সংকটের মধ্যে রমজানে স্বাভাবিক মূল্যে ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছানোর বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় সভা করছেন তারা। বাজার মনিটরিং জোরদার করতে মাঠে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৬ জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে আটটি মনিটরিং টিম, টিসিবির দুটি ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের টিমগুলো পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। টিসিবি, ভোক্তা অধিকারসহ তদারকির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। তার পরও স্বস্তিতে নেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের বেশি বেশি পণ্য আমদানি করতে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক করে উৎপাদকদের বলা হয়েছে মিল গেটে পণ্য সরবরাহ বাড়াতে। এর উত্তরে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা এ সংকটে পণ্য আমদানিতে ভরসা পাচ্ছেন না। আবার ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত থাকায় আমদানি জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় এলসি করার সুযোগও সীমিত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমদানি ও সরবরাহে হঠাৎ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, শুধু জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করতে দেরি হওয়ায় আদার কেজি ৩০০ টাকা ছাড়িয়েছে। অথচ বন্দরে কনটেইনারজট কমাতে পারলেই এ পণ্যটির দাম অর্ধেকে নেমে আসবে।

বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রামের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের খাজা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আবদুল মান্নান বলেন, বন্দরের মাল ছাড়াও দোকানে কিছু আদা আছে ১২০ টাকা কেজি দরের। সরকার যদি একটু তদারকি করে, বাজার নেমে যাবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বাজার মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনায় যুক্ত থাকার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়মিত তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদের অন্যান্য কাজ রয়েছে। করোনা সংকটে চলমান লকডাউনে মানুষকে ঘরে রাখার কাজ করতে গিয়ে তাদের বেশি ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। ফলে চাইলেও প্রয়োজনীয় পুলিশ দিতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করাটাও এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের বেশি চাপও দেওয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি একটি বাজারে অভিযান চালানোর পর ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে চলে যান বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণের এ চ্যালেঞ্জগুলো স্বীকার করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোজার মাস নিয়ে আমরা ছয় মাস আগে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি মূল্য স্থিতিশীল রাখতে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু করোনা সংকটের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও লকডাউন কার্যকর হওয়ায় হঠাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে গেছে। এতে পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি পর্যায়ে কিছুটা বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে।’

সচিব জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলছেন, তাদের সমস্যাগুলো শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। বন্দরের জট ছাড়াতে এরই মধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, এমনকি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকেও চিঠি লেখা হয়েছে। পণ্যের এলসি খোলা ও ডলারের দাম কমানোর বিষয়ে মন্ত্রী ও সচিব উভয় পর্যায় থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আদাসহ আমদানিকৃত নিত্যপণ্যের ভ্যাসেলগুলো দ্রুত খালাস করার বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষা কিছুটা শিথিল করে যাতে দ্রুত নিত্যপণ্য ছাড় করা হয় সে বিষয়ে এনবিআরকেও অনুরোধ জানানোর কথা জানান বাণিজ্য সচিব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর