মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা
ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

চিরদিনই অন্ধকার থাকে না, আবার আলোর পথে যাত্রা করব

নিজস্ব প্রতিবেদক

চিরদিনই অন্ধকার থাকে না, আবার আলোর পথে যাত্রা করব

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অর্থনীতি যেন সচল থাকে এজন্য যেসব জায়গায় করোনাভাইরাস বেশি দেখা দেয়নি, আস্তে আস্তে লকডাউন শিথিল করে দিচ্ছি। তিনি বলেন, সবাই মিলে কাজ করলে এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে মুক্তি পাব। চিরদিনই অন্ধকার থাকে না। আলো নিশ্চয়ই আসে। আমরা আবার আলোর পথে যাত্রা শুরু করব।

গতকাল গণভবনে রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সূচনা বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। ভিডিও কনফারেন্সে জেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সিভিল সার্জন-চিকিৎসক নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মতবিনিময় করেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে মহাখালীস্থ স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ-দফতর এবং আইইডিসিআরও ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ স্বাভাবিক জীবন-যাপনটা যাতে করতে পারে বা ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে, সেদিকে আমরা দৃষ্টি দিচ্ছি। আমি বিশ্বাসী, এই অবস্থা থাকবে না। এই দুঃসময় আমরা কাটিয়ে উঠব এবং আমাদের আবার শিল্প-কলকারখানা সব চালু হবে এবং দেশের অর্থনীতি সচল হবে। সেদিকে আমরা বিশেষভাবে কাজ করে যাবে। কিছু কিছু জীবন-যাপন আস্তে আস্তে উন্মুক্ত করতে হবে। সেখানেও সবাই নিজেকে সুরক্ষিত রেখেই কাজ করবে। তিনি বলেন, দুর্যোগ আমাদের আসে, দুর্যোগ আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। আর এই দুর্যোগটা তো বিশ্বব্যাপী। একটা অস্বাভাবিক অবস্থা। এ ধরনের অবস্থা আর আমরা দেখিনি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন অচলাবস্থার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা অর্থনৈতিকভাবে বিরাট ধাক্কা। কারণ আজকে যেসব দেশে আমরা রপ্তানি করতাম সেসব দেশেও করোনার কারণে তা বন্ধ। তাদের সব কার্যক্রম বন্ধ। আবার আমাদের দেশেও সেই একই অবস্থা করতে হয়েছে মানুষের নিরাপত্তার জন্য। কারণ এখানে মানুষের নিরাপত্তাটাই হচ্ছে আমাদের কাছে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

পণ্য বিক্রি ও পণ্য পরিবহনে বাধা নেই : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পণ্য বিক্রি, পণ্য পরিবহনের ব্যাপারে কোনো বাধা নেই। পণ্য পরিবহনের জন্য সুযোগ করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া আরও কীভাবে পণ্য পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে, মানুষের জীবনযাত্রা অব্যাহত থাকে, সেদিকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

ঋণের সুদ নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না : ব্যবসা পরিচালনার জন্য ঋণের সুদ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগবেন না। যারা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেছেন, কিন্তু এই করোনাভাইরাসের কারণে এই কয় মাস সবকিছু বন্ধ থাকায় ঋণের সুদ বেড়ে গেছে, সেটার জন্য চিন্তা করবেন না। কারণ সেই সুদ এখনই নেওয়ার কথা না। সুদ কতটুকু মাফ করা যায় বা কতটুকু নিয়মিত করা যায় এটি সরকারের বিবেচনায় আছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বসব। কাজেই এই সুদগুলো যাতে স্থগিত থাকে, পরবর্তী সময়ে কতটুকু মাফ করা যায়, কতটুকু আপনারা নিয়মিত দিতে পারেন, সেটা বিবেচনা করা হবে। কাজেই সেদিকে দুশ্চিন্তায় ভুগবেন না। বিভিন্ন সেক্টরে প্রণোদনা ঘোষণার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একবারে ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে শুরু করে, যেমন মৎস্য চাষি থেকে পোলট্রি, ডেইরি ও কৃষিকাজ যারা করেন বা বিভিন্ন ধরনের ছোটখাটো ব্যবসা বা ক্ষুদ্র ব্যবসা যারা করেন, প্রত্যেকের কথা চিন্তা-ভাবনা করে এবং অন্যদিকে খেয়াল রেখে আমরা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছি এবং সেটা বিভিন্ন ভাগে ভাগে। যাদের ছোটখাটো ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাত্র ২ শতাংশ সুদে আমরা টাকা দিয়ে দিচ্ছি। ব্যবসাগুলো যাতে চালু রাখতে পারেন সে বিষয়টি আমরা দেখব।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যেসব এলাকায় কম সেখানে ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিল করার ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে সবচেয়ে বড় কথা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা। আমাদের জীবন-জীবিকার পথটা উন্মুক্ত রাখা।

প্রতি জেলায় আইসিইউ, শিগগিরই আট হাজার চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ : প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা স্বাস্থ্যসেবার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছি। জেলাতেই যেটা ভালো হাসপাতাল, সেখানে আইসিইউর ব্যবস্থা করব। পর্যায়ক্রমে সব জেলাতেই এটা করে দেব। শেখ হাসিনা বলেন, করোনার চিকিৎসা করতে আমরা প্রায় ২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেব।

করোনার পরিস্থিতি চললে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ : করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা এখন স্কুল-কলেজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলব না। অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল-কলেজ সবই বন্ধ থাকবে, যদি করোনাভাইরাস অব্যাহত থাকে। যখন এটা থাকবে না, তখনই খুলব।

ভিক্ষুক নাজিম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন : শেরপুর জেলার ভিক্ষুক নাজিমুদ্দিন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং তার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন ভিক্ষুক ভিক্ষা করে ১০ হাজার টাকা জমা করেছিল নিজের ঘর ঠিক করার জন্য। ছেঁড়া একটি পাঞ্জাবি গায়ে। ঘরে খাবারও ঠিকমতো নেই। কিন্তু তারপরও সেই মানুষ ওই ১০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন করোনাভাইরাসে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের সাহায্যের জন্য। আমি মনে করি, সারা বিশ্বে এটা মহৎ দৃষ্টান্ত তিনি সৃষ্টি করেছেন। এত বড় মানবিক গুণ আমাদের অনেক বিত্তশালীর মাঝেও দেখা যায় না। কিন্তু একজন নিঃস্ব মানুষ, যার কাছে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 ওই টাকা দিয়ে তিনি অনেক কিছু করতে পারতেন। কোনো চিন্তা তিনি করেননি। সেটা তিনি দান করেছেন। এই যে একটা মহৎ উদারতা দেখালেন, বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এখনো এই মানবিক বোধটা আছে। কিন্তু সেটা আমরা পাই, যারা নিঃস্ব তাদের কাছে। অনেক সময় দেখি, অনেক বিত্তশালী হা-হুতাশ করেই বেড়ান। কিন্তু তাদের নাই নাই অভ্যাসটা যায় না। তাদের চাই চাই ভাবটা সব সময় থেকে যায়। 

কৃষি উৎপাদন বাড়ান : কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি মনোযোগ দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিশেষজ্ঞরা মন্দা বা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন। এজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বেশি করে খাদ্যশস্য ফলাতে হবে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, কৃষি এখন সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকে খাদ্যশস্য, সবজি, মসলা, মাছ-মাংস সবই পাওয়া যায়। আমি দেশবাসীকে অনুরোধ করব, কৃষিতে মনোযোগ দিতে। আপনারা কৃষি উৎপাদন বাড়ান। তাতে আমরা নিজেরা যেমন খেতে পারব, অন্যদেরও সাহায্য করতে পারব। 

রূপপুর প্রজেক্টের কেউ এলে আগেই কোয়ারেন্টাইন : পাবনা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, রূপপুর প্রজেক্টে কর্মরত যারা চলে গিয়েছিলেন তারা আবার আসছেন। তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। রাশিয়ায় আবার নতুন করে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এজন্য রূপপুর প্রজেক্টে যারা আসবেন তাদের আগে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। কোয়ারেন্টাইন শেষ হলে তাদের কাজে লাগাতে হবে।

নাটোর জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই একটা জেলা পেলাম যেখানে এখন পর্যন্ত একটাও করোনা আক্রান্ত রোগী দেখা যায়নি। আপনারা যথেষ্ট ভালো রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তার মানে নাটোরের কারও শ্বশুরবাড়ি নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর বা শিবচরে নেই। দেখা যাচ্ছে নিজের বাড়ি না গিয়ে শ্বশুরবাড়ি ওঠে। সেইসঙ্গে করোনার সংক্রমণ ঘটায়। অবশ্য এ সময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের জেলায় প্রচুর লোক যাচ্ছে। তবে তারা তাদের সবার হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করেছেন।

গরুর দুধ ত্রাণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে : যেসব এলাকায় ডেইরি খামার বেশি সেসব এলাকায় দুধ ত্রাণ হিসেবে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাবনা জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জ-পাবনা এসব এলাকার দুগ্ধ খামারিদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। রিলিফ হিসেবে এই দুধও আপনারা দিয়ে দিতে পারেন।

সর্বশেষ খবর