বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

খাদ্য সংকটে পড়তে পারে বিশ্ব

বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কৃষি শিল্প উৎপাদন বাড়ানো ও ব্যবসা-বাণিজ্য সচলের পক্ষে বিশেষজ্ঞরা

মানিক মুনতাসির

মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের আঘাতে সারা বিশ্বই এখন দিশাহারা। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কৃষিসহ সব ধরনের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সেই সঙ্গে সারা বিশ্বের সরবরাহ চেইনও প্রায় ভেঙে পড়েছে। এ পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে সংস্থাটি সতর্কতাও জারি করেছে। বাংলাদেশও এ আশঙ্কা থেকে বাদ পড়ছে না। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় সারা বিশ্বেই লকডাউন চলছে। এতে সব ধরনের উৎপাদন প্রক্রিয়া চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এটা দীর্ঘায়িত হলে সারা বিশ্বেই দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হবে। সংস্থাটির তথ্যমতে, ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী পায় ৮০ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছেন। সামনের দিনে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।

এদিকে অন্যান্য উৎপাদন ও রপ্তানি খাতের বিপর্যয় এড়াতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে সীমিত আকারে খোলা হয়েছে দেশের তৈরি পোশাক কারখানা। পর্যায়ক্রমে বাকিগুলোও খুলে দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কর্মহীনতা আর অভাব মানুষকে অপরাধমুখী করে তুলবে। ফলে ধাপে ধাপে সব কারখানাই খুলে দিতে হবে। এর পাশাপাশি অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো সচল রাখতে হবে যে কোনো মূল্যে। বাংলাদেশ যেহেতু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে তাই নিজেদের বাম্পার উৎপাদন ও সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যও সচল রাখতে হবে। মানুষকে কাজের সুযোগ দিতে হবে। কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য না চললে মানুষ কাজ করতে পারবে না। মানুষের কাজ না থাকলে আয় বন্ধ হয়ে যাবে। যার ফলে মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ বাড়বে না। ফলে খাদ্য মজুদ থাকলেও মানুষ তা কিনতে পারবে না। আবার উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সচল না থাকলে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হবে। যা ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষে রূপ নেবে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিমাণ খাদ্য মজুদ রয়েছে তা দিয়ে অন্তত এক বছর চলা সম্ভব। চলতি বোরো মৌসুমেও বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতিমধ্যে হাওর এলাকায় বোরো ধান মাড়াই শুরু হয়েছে। কিন্তু এই করোনাভাইরাস আতঙ্কে ধান কাটা ও মাড়াই কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। আগামী মাসের প্রথম দিকেই সারা দেশে ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হবে। এদিকে আগাম বন্যা ধেয়ে আসারও বার্তা দিচ্ছে আবহাওয়া অধিদফতর। ফলে বন্যার আগেই ধান কেটে ঘরে তুলতে হবে। যা এখন রীতিমতো প্রধান চ্যালেঞ্জ। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার পাশাপাশি ধান কেটে ঘরে তোলা ও অন্যান্য উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখতে পারলে দুর্ভিক্ষ থেকে রেহাই পাবে বাংলাদেশ। একই রকমভাবে সারা বিশ্বের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য লকডাউন শিথিল করে প্রত্যেক দেশের সব ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো সচল রাখার কোনো বিকল্প নেই বলে তাঁরা মনে করেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে প্রায় ১২ লাখ টনের বেশি খাদ্য মজুদ রয়েছে। যা গত ২৪ মার্চ পর্যন্ত ছিল ১৬ লাখ ৯৫ হাজার টন খাদ্যশস্য। চলমান সাধারণ ছুটির কারণে কর্মহীন, দরিদ্র মানুষের মাঝে ইতিমধ্যে ৫ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য বিতরণ ও ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে আট লাখ টন ধান কিনবে সরকার। যা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। প্রতি মণ ধানের দাম প্রায় ১ হাজার ৪০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে চলতি বোরো মৌসুমে সরকারের কাছে প্রায় ২ হাজার ৮০ কোটি টাকার ধান বিক্রি করতে পারবেন সারা দেশের কৃষকরা। সরকারের এই ধান ক্রয় কার্যক্রম চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। এদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামীকাল খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠক ডেকেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে বোরো মৌসুমে ধান চাল ক্রয়, খাদ্য মজুদ পরিস্থিতিসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা করা হবে। খাদ্য বিভাগের তথ্যমতে, আমাদের প্রতি মাসে খাদ্যের চাহিদার গড় ১৯ থেকে ২১ লাখ টন। যার প্রায় ৮০ ভাগই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মিটানো হয়। খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে প্রতি বছর ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। এবার প্রায় ১৩ লাখ টন গম অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে গম মাড়াইও শুরু হয়েছে। বাকিটা আমদানি করতে হয়। চলতি বছরের গমের চাহিদার প্রায় সিংহভাগ ইতিমধ্যে আমদানি করা হয়েছে। অন্যদিকে এ বছর ভুট্টা উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৪৪ লাখ টন। ভুট্টা মাড়াইয়ের কাজও শুরু হয়েছে।

উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন ঠিক থাকলে খাদ্য সংকট হবে না : খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) সারোয়ার মাহমুদ বলেছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে সারা বিশ্বেই স্থবিরতা নেমে এসেছে। সব ধরনের উৎপাদন কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। জাতিসংঘ খাদ্য সংকটের ব্যাপারে সতর্ক করেছে। আমরা সেভাবেই পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। আমাদের কৃষি, শিল্পসহ সব ধরনের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে হবে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি আরও বলেন, খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি বর্তমানে খুবই সন্তোষজনক। মজুদ বাড়াতে স্থানীয়ভাবে ধান-চাল সংগ্রহের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেড় লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ হাজার টন আনা হবে আর্জেন্টিনা থেকে বাকি এক লাখ টন রাশিয়া থেকে আনার আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকার সারা বছরই মৌসুম ভেদে খাদ্য শস্য সংগ্রহ করে। সে সব কর্মসূচিও চালু রয়েছে। শুধু সরকারি পর্যায়েই নয় বেসরকারি পর্যায়ে আরও অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্য মজুদ রয়েছে। ইতিমধ্যে সারা দেশে ওএমএস কর্মসূচি চালু রয়েছে। একইভাবে ভর্তুকি মূল্যে ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে দুর্যোগ মোকাবিলার অংশ হিসেবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ, মাংস, শাক-সবজি এর কোনোটাই আমাদের আমদানির প্রয়োজন হয় না। বরং কোনো কোনোটা রপ্তানির মতো সক্ষমতা রাখি। ফলে করোনাভাইরাস মহামারীতেও আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। এছাড়া কৃষকের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটার ব্যবহার করতে পারলে বিশ্বের অন্য দেশে খাদ্য সংকট হলেও আমাদের দেশে তা হবে না বলে তিনি মনে করেন।

খাদ্য সংকট দীর্ঘায়িত হতে পারে : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দীর্ঘায়িত হতে পারে। দুর্ভিক্ষ হতে পারে জাতিসংঘের দেওয়া এই সতর্কতা অমূলক নয়। প্রায় পাঁচ মাসের বেশি সময় সারা বিশ্ব অচল হয়ে রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। কৃষি ও শিল্পসহ প্রায় সব ধরনের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তার তো একটা প্রভাব আছেই। তবে সংকট কী মাত্রার হবে সেটা এখনই বলা যাবে না। কেননা এটা আরও কতটা দীর্ঘায়িত হয় সেটার ওপর নির্ভর করছে খাদ্য পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এমনিতেই নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিলেন তারাও কিন্তু নিচে নেমে যাবেন। ইতিমধ্যে অনেকেই নেমেও গেছেন। এর সংখ্যাটা খুবই আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে। কেননা মানুষের কাজ নেই। লকডাউন চলাকালে তারা সঞ্চয় ভেঙে এমনকি ধারকর্জ করে চলছিলেন। এখন তো সেটাও শেষ। ফলে তাদেরকে কাজ দিতে না পারলে তারা কীভাবে নিজেদের বাঁচাবেন সেটাই বিয়ষ। আরেকটা বিষয় হলো, করোনাভাইরাসের প্রভাবকে কেন্দ্র করে বেকারত্বও বাড়বে। একটা হচ্ছে কর্মহীনতা। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকার কারণে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা হয়তো আবার কাজে যোগ দিতে পারবেন। অন্যটা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক বা অবকাঠামোগত বেকারত্ব। অর্থাৎ অনেকেই চাকরি হারাবেন। আবার এখন যারা কর্মহীন তাদেরও কাজ পেতে সমস্যা হবে। ফলে ওই সমস্যা সবচেয়ে বেশি জটিল। এই সমস্যাগুলো স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য সংকটকে প্রভাবিত করবে। যার ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট তৈরি হতে পারে। এটা থেকে হয়তো বাংলাদেশও বাদ যাবে না। এ থেকে বাঁচতে আমাদের নিজেদের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে। এ জন্য আমাদের কৃষি ব্যবস্থাপনায় নজরদারি বাড়াতে হবে। কৃষককে সুরক্ষা দিয়ে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। অন্যান্য শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোকেও সচল রাখতে হবে। অন্যথায় সংকট এড়ানো খুবই কঠিন হয়ে পড়বে বলে তিনি মনে করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর