শুক্রবার, ১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

শিল্প খাতে ২ কোটি মানুষ বিপর্যয়ে

পাঁচ হাজার বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২০ লাখ মানুষ। শিল্প কারখানা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও গুনতে হচ্ছে ব্যাংক ঋণের বিপুল অঙ্কের সুদ। ব্যাংক সুদ আর ইউটিলিটি বিল মওকুফের দাবি ব্যবসায়ীদের। ছোট শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। কুটিরশিল্পের সঙ্গে জড়িত এক কোটি ২০ লাখ লোক। কর্মহীন হয়ে পড়া এসব লোক খাদ্য সংকটে পড়বে। এতে সামাজিক সংকটও বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সংকট উত্তরণে পর্যায়ক্রমে লকডাউন শিথিল করে কারখানা চালুর দাবি

মানিক মুনতাসির

করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে দেশের সব ধরনের শিল্প খাতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। সীমিত আকারে চালু হয়েছে তৈরি পোশাক খাত। অন্যান্য শিল্পের মধ্যে কুটির, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত অন্তত আড়াই কোটি মানুষ। এর মধ্যে অন্তত দুই কোটি মানুষ এখন বিপর্যয়ের মুখে। শুধু বৃহৎ শিল্পের সঙ্গেই জড়িত প্রায় ২০ লাখ মানুষ, যারা পুরোপুরি বিপর্যস্ত। কারখানা বন্ধ থাকলেও এসব শিল্পের বিপরীতে নেওয়া ব্যাংক ঋণের সুদ গুনতে হচ্ছে বিপুল অঙ্কের। এ জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের সুদ এবং ইউটিলিটি বিল মওকুফের দাবি জানিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বেসরকারি খাত হাজার হাজার ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ সব শিল্প প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই আমদানির বিকল্প হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে। এ ছাড়া রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসব শিল্পের সঙ্গে দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। করোনাভাইরাসের কারণে এদের সবার জীবন-জীবিকা আজ হুমকির মুখে। জীবন যুদ্ধের এই মুুহূর্তে সরকারি তেমন কোনো সহযোগিতাও পাচ্ছেন না এই শ্রেণির মানুষ।  

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত আছেন প্রায় ৬০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। এর বাইরে কুটির, মাঝারি, বৃৃহৎ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শিল্প মালিক, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজসহ এসব শিল্প খাতে মোট আড়াই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। বিবিএসের ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সারা দেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ৬৮ লাখ ৪২ হাজার, ক্ষুদ্র্র শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০ লাখের বেশি, ছোট শিল্প রয়েছে প্রায় ৯ লাখ, মাঝারি শিল্প রয়েছে ৭ হাজার, বৃহৎ শিল্প রয়েছে ৫ হাজার ২৫০টি। সবমিলিয়ে দেশে শিল্পের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৮ হাজারের বেশি। এসব শিল্পের আড়াই কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি মানুষই এখন বিপর্যয়ে পড়েছেন। টানা এই লকডাউনের মধ্যে এদের জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়েছে। আর এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে শিল্প কারখানার মালিকরা আদৌ শিল্প টিকিয়ে রাখতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যেই অনেক শিল্প মালিক ও উদ্যোক্তা তাদের প্রতিষ্ঠান লে-অফ ঘোষণার কথা ভাবছেন বলে জানা গেছে। দীর্ঘ দুই মাস লকডাউনের কারণে প্রায় সব শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন করলেও পরিবহন ব্যবস্থা স্থবির থাকায় তা ঠিক মতো সরবরাহ করতে পারছে না। এ ছাড়া বড় বড় বাণিজ্যিক এলাকাগুলোসহ সর্বত্রই পাইকারি বাজার, মোকাম বন্ধ থাকায় পণ্য বিপণনে নেমে এসেছে মারাত্মক বিপর্যয়। দীর্ঘ সময় ধরে পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন বন্ধ থাকায় এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের আয় প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে লাখ লাখ শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক কর্মচারীর বেতন ভাতাসহ, বাধ্যতামূলক গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলসহ সব ধরনের ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। পাশাপাশি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি সব ধরনের ঋণের সুদ অব্যাহত রয়েছে। এতে শিল্প মালিকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। অপরদিকে সরকার ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা বাস্তবায়ন নিয়েও রয়েছে জটিলতা। এ অবস্থায় গার্মেন্ট শিল্পের মতো এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সরবরাহ ও বিপণনের ওপর থেকে লকডাউন শিথিলের দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকসুদ ও ইউটিলিটি বিল মওকুফের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যথায় এসব শিল্পকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন শিল্প খাত সংশ্লিষ্টরা। এ অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে শিল্প খাতে নেমে আসবে হতাশা ও অনিশ্চয়তা। এতে কর্মহীন মানুষ অভাবের তাড়নায় সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারীর অভিঘাতে বিশ্বব্যাপীই অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা চলছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়, বরং ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঝুঁকি আরও বেশি। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সারা দেশ কার্যত একটা লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যেই সামনে চলে এসেছে দেশের শিল্প খাতে ধসের আশঙ্কা। সাধারণত স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ ও দুই ঈদের উৎসবকে কেন্দ্র করেই কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি শিল্পের জমজমাট ব্যবসা হয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর সবকিছুই বন্ধ থাকায় ঈদকে ঘিরেই অন্তত এক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় আপাতত বেকার হয়ে পড়েছে সমগ্র শিল্প খাতের অন্তত দুই কোটি মানুষ। ওয়ার্ল্ড এসএমই ফোরামের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ৭৮ শিল্পের মধ্যে ৬০ লাখ ৮০ হাজারই কুটিরশিল্প, ক্ষুদ্রশিল্প ১ লাখ ১০ হাজার, ছোট শিল্প ৮ লাখ ৫০ হাজার, মাঝারি শিল্প ৭১ হাজার আর বৃহৎ শিল্প রয়েছে ৫২ হাজার। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পঞ্চম স্থানে থাকা বাংলাদেশ এসএমই শিল্পসংখ্যায় বিশ্বে এখন সপ্তম স্থানে রয়েছে। দেশে এসএমই খাতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ ৭৩ লাখ। এসব পরিসংখ্যানে স্পষ্ট দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই শিল্পের উদ্যোক্তারা এখন উল্টো পুঁজি হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।

শিল্পখাতের বিপর্যয় ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। আর কুটির, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ছোট শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এই প্রণোদনার অর্থ কারা কীভাবে পাবেন এ নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা এই সুবিধা পাবেন কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রতি মাসের ইউটিলিটি সার্ভিসের খরচ। যা এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে না। কিন্তু বকেয়া থাকছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এটা আবার পরিশোধ করতে হবে। যা উদ্যোক্তাদের জন্য হবে অতিরিক্ত বোঝা। এজন্য এই বিল মওকুফ করে শিল্প খাতকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন শিল্প খাত সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির পরিচালক আবুল কাশেম খান এ প্রসঙ্গে বলেন, শিল্প খাতের বিপর্যয় ঠেকাতে হলে সরকারের সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। এ খাতের সঙ্গে দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। আমরা এখন ধীরে ধীরে শিল্প বিপ্লবের দিকেই এগোচ্ছি। ঠিক এই মুুহূর্তে করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলাতে পুরো শিল্প খাতকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর কারণে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। ছোট উদ্যোক্তা তো বটেই অনেক বড় শিল্পই বিপর্যয় ঠেকাতে পারবে না বলে তিনি মনে করেন।

এসএমই শিল্পের উদ্যোক্তা কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাজেদুর রহমান বলেন, এখন যে পরিস্থিতি চলছে এটা আরও এক মাস দীর্ঘায়িত হলে কারখানা অটোমেটিক সাটডাউন হয়ে যাবে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে যাবে। আমাদের ব্যাংক হয়তো দেউলিয়া হয়ে যাবে। ফলে সরকারের সহযোগিতা খুবই জরুরি। কমপক্ষে ব্যাংকের সুদ মওকুফ করা দরকার। ইউটিলিটি বিল ডিসেম্বর পর্যন্ত মওকুফ না করলে আমরা বাঁচতে পারব না। এ ছাড়া পোশাক খাতের মতো সীমিত আকারে ধীরে ধীরে শিল্প খাত থেকে লকডাউন তুলে নেওয়ারও দাবি জানান তিনি। এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে শুধু আমরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি তা নয়, সারা বিশ্বই বিপর্যস্ত। তবে আমাদের শিল্প রক্ষায় সরকার কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সেগুলোর বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। এসব উদ্যোগ শিল্প খাতের বিপর্যয় ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর