সোমবার, ৪ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

গভীর সংকট আসছে সামনে

শিল্প খাতে বিপর্যয়, ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা, আর্থিক সংকটে বাড়বে বেকারত্ব, ধান ও সবজির বাম্পার ফলনে ন্যায্যমূল্য নিয়ে আশঙ্কা, ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী

মানিক মুনতাসির

গভীর সংকট আসছে সামনে

সামনে গভীর সংকট ঘনিয়ে আসছে। মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের প্রভাবে শিল্পের সঠিক উৎপাদন, বণ্টন না হওয়ায় হতে পারে কর্মী ছাঁটাই। অন্যদিকে শিল্প-কারখানায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে নতুন নিয়োগ। এতে বেড়ে যাবে বেকারত্ব। কৃষিতে বাম্পার ফলন হলেও পণ্য পরিবহনে প্রতিবন্ধকতা আর ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় সামনে সমস্যা আরও তীব্র হতে পারে। সবজি ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে অসহায়ত্ব ব্যক্ত করেছেন। কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পেলে একদিকে যেমন উৎপাদনে উৎসাহ হারাবেন, অন্যদিকে পরবর্তী মৌসুমে কৃষিপণ্য সংকটে বেড়ে যাবে পণ্যমূল্য। অর্থনীতি হারাবে তার ভারসাম্য। এদিকে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারানোর শঙ্কায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন। ইতিমধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। আর নতুন করে অন্তত ২ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বেন এমন তথ্য জানিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি ও ব্র্যাক। এদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ১৬০ কোটি মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন, যা মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অর্ধেক। বাংলাদেশও রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। যেহেতু এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা। ফলে সারা বিশ্বই এখন দিশাহারা। আমাদের দেশে এর প্রভাবটা হবে চতুর্মুখী। একদিকে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। আবার নতুন করে কাজের সুযোগও কমবে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে যারা চলে এসেছেন তারা আদৌ কাজে ফিরতে পারবেন কিনা, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। আর রপ্তানির বাজার তো বিপর্যস্তই হয়ে পড়েছে। এখন ভরসা শুধু অভ্যন্তরীণ উৎপাদন। এটাকে চাঙ্গা রেখেই চাহিদা বাড়িয়ে সংকট কাটানোর পথ খুঁজতে হবে বলে তিনি মনে করেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বন্ধ রাখা হয়েছে সব ধরনের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, অধিকাংশ অফিস-আদালত, দোকানপাট। চাকা ঘুরছে না শিল্প খাতের। অথচ ব্যাংক ঋণের সুদের টাকা বাড়ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ফলে সামনের দিনগুলোতে শিল্প খাতে আরও বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। আর জীবন-জীবিকার কোনো হিসাবই মিলাতে পারছেন না নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে দেশের অন্তত সাড়ে ৬ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে। যা দেশে সামাজিক সংকট তৈরি করবে। ফলে সামনের দিনের সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলার জন্য এখনই ভাবতে হবে। নিতে হবে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ খাদ্য মজুদ রয়েছে তাতে অন্তত আগামী এক বছর দেশে খাদ্যের কোনো সংকট হবে না। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ যারা দিন আনে দিন খায় তারা কাজ করতে না পারায় সংকটে পড়েছেন। এই শ্রেণির মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সামাজিক সংকট তৈরি হবে। যা দেশের বিভিন্ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তারা মনে করেন।

শিল্প খাত-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ খাতকে রক্ষার জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ করলে ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা স্বস্তি আসবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর জন্য সুদবাবদ ভর্তুকিও দিতে পারে সরকার। অর্থাৎ সুদের একটা অংশ সরকার তার ঘাড়ে নিয়ে নিতে পারে। এতে ব্যাংকগুলোর যেমন মুনাফা কমবে না, তেমন কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটবে না শিল্প কিংবা ব্যাংক খাতে। একতরফাভাবে ব্যাংক ঋণের সুদ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে করোনা-পরবর্তীতে হয়তো অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে জনবল কমিয়ে আনার কথা ভাববে। অনেকেই হয়তো এই ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে টিকতেই পারবে না। আবার ব্যাংকগুলোর ব্যবসা ভালো না হলে তারাও জনবল কমিয়ে আনার কথা চিন্তা করবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব সেক্টরকে বাঁচাতে হলে একটি সমন্বিত পলিসি গ্রহণ করতে হবে। যার ফলে শিল্প উদ্যোক্তারাও বাঁচবেন আবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষও মুনাফা করতে পারবেন। একইভাবে শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকতে পারবে। এতে সারা দেশের অর্থনীতিও সচল থাকবে বলে তারা মনে করেন।

এদিকে বিনিয়োগকৃত পুঁজি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা। কারণ, সরকার এ খাতের যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সেটা শুধু তারাই পাবেন, যাদের ব্যাংকে ঋণ এবং জামানত রয়েছে। কিন্তু এ খাতের প্রায় ৯০ ভাগ উদ্যোক্তারই ব্যাংকে কোনো জামানত বা ঋণ নেই। ফলে ওই প্রণোদনার সুবিধা তারা আদৌ পাবেন কিনা, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ ছাড়া এ শিল্পের উৎপাদন ও বিপণন টানা দুই মাস বন্ধ থাকায় শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, ব্যাংক ঋণের কিস্তি আর ইউটিলিটি সার্ভিসের বিল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। আর কর্মহীন হয়ে পড়ায় শ্রমিক-কর্মচারীরাও চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। এসএমই ও এমএসএমই খাতের সুরক্ষায় সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকার একটি ঘুর্ণায়মান তহবিল গঠনও করেছে। কিন্তু এর সুুবিধা আসলে কারা পাবেন তা নিয়ে কথা উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীরা এর কতটুকু সুবিধা পাবেন তা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার ইতিমধ্যে শিল্প, কৃষি, এসএমই খাতের জন্য পৃথক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এখন এই প্রণোদনার অর্থের সঠিক বণ্টনই বড় কথা। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে প্রণোদনা পৌঁছাতে না পারলে আর্থিক খাতের বিপর্যয় ঠেকানো খুব কঠিন হয়ে পড়বে। এমনিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। এতে কর্মহীন মানুষের তালিকা শুধু বাড়বেই। অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বাড়বে। ফলে সামনের দিনগুলো হবে বেশ বিপজ্জনক। তবে এর ভয়াবহতা ততটাই বেশি হবে করোনাভাইরাসের প্রভাব যতটা দীর্ঘায়িত হবে। তিনি আরও বলেন, দেশের মোট শ্রমিকের প্রায় ৮৫ ভাগই অনানুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে যুক্ত। বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে স্থায়ী ও টেকসই কর্মসংস্থানের বিষয়টি জড়িত। এ খাতের শ্রমিক-কর্মচারীরা নিরাপদ বোধ করেন কোম্পানির আর্থিক ভিতের কারণে। কিন্তু তারাও আজ বিপর্যস্ত। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের হিসাব রাখা বেশ কঠিন। এ ছাড়া তারা তো সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু যারা শিল্প খাতে কাজ করেন তাদের সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষিত থাকে। সেখান থেকে তাদের তালিকা ধরে সরকার চাইলে খাদ্য রেশনিং করতে পারে। যা শিল্পের মালিকদের জন্য বিরাট সহায়তা হিসেবে কাজ করবে বলে তিনি মনে করেন।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর