সোমবার, ৪ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
সরেজমিন রাজধানী

সন্ধ্যা হলেই খাবার চাইতে রাজপথে নামে ওরা

জিন্নাতুন নূর

সন্ধ্যা হলেই খাবার চাইতে রাজপথে নামে ওরা

ঢাকার রাস্তায় ত্রাণের জন্য অপেক্ষা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

মিরপুর-২ নম্বর এলাকার একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন নাজমুন বেগম। করোনার কারণে এক মাসের বেশি সময় কারখানা বন্ধ। এ জন্য চল্লিশোর্ধ্ব নাজমুনের হাতে এখন কাজ নেই, ফলে নেই কোনো মজুরিও। দুই সন্তানকে নিয়ে বস্তির ঝুঁপড়িঘরে আগে কোনোরকম দুবেলা খেয়ে-পরে বাঁচলেও রোজগার না থাকায় এখন নাজমুনকে মিরপুর-২ নম্বর থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত সড়কে ভিক্ষা করতে হচ্ছে। কেন প্রাইভেট কার দেখলেই তিনি ছুটে যান ত্রাণের আশায়। নাজমুন বলেন, ‘নিজে না খাইলে সমস্যা নাই কিন্তু বাচ্চাগুলোরে তো আর উপাস রাখা যায় না। বাসাবাড়িতে কেউ ঢুকতে দেয় না। তাই রাস্তায় নামছি ভিক্ষা করতে।’

পল্লবী আবাসিক এলাকায় বাসায় বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে মাসে ১৬ হাজার টাকা রোজগার করতেন সুফিয়া বেগম। কিন্তু করোনার কারণে গত দুই মাস ধরে সুফিয়ার সব বাসায় যাওয়া বন্ধ। এসব বাসা থেকে এরই মধ্যে সুফিয়াকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে মার্চ-এপ্রিলের বেতন দেওয়া হবে না। আবার কবে নাগাদ বাসা বাড়িতে কাজ শুরু করবেন তাও জানেন না। এই অবস্থায় অসুস্থ স্বামী ও তিন মেয়েকে নিয়ে কীভাবে চলবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। নিরুপায় হয়ে সড়কে সড়কে এখন দিন-রাত ত্রাণের আশায় বসে থাকেন তিনি। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো থেকে শুরু করে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার অলি-গলিতে এখন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশুদের হাত পেতে বসে থাকতে দেখা যায়। ক্ষুধার জ্বালায় লকডাউনের মধ্যেও দরিদ্র ও অসহায় এসব মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এই মানুষগুলো সাহায্যের আশায় সড়কে বসে থাকেন। দিনের আলোতে লোকলজ্জায় নামতে না পেরে অনেকে সন্ধ্যা হলেই রাস্তায় নামছেন। হাত পেতে বলছেন, ‘একটু সাহায্য করেন বাবা’। কেউ কেউ কাগজে সাহায্যের আবেদন লিখে নগরীর বিভিন্ন অভিজাত পাড়া-মহল্লার সড়কে বসে থাকেন। এদের কারও কপালে খাবার জুটলেও অনেকেরই জুটে না। কিছুদিন আগে বিভিন্ন এনজিও ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে রান্না করা খাবারের প্যাকেট দেওয়া হলেও রমজান মাস হওয়ায় এখন ইফতারের প্যাকেট ছাড়া অন্য খাবার দেওয়া হচ্ছে না। সরেজমিন রাজধানীর মিরপুর, হাতিরঝিল, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান, এয়ারপোর্ট রোড, ধানমন্ডি, আসাদগেট, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের ওপর দল বেঁধে বা বিচ্ছিন্ন হয়ে এসব অসহায় ও দরিদ্র মানুষ সাহায্যের আশায় দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন। এদের মধ্যে ভাসমান মানুষ ছাড়াও আছে নিম্নআয়ের মানুষ, দিনমজুর, হকার ও গৃহকর্মী। দরিদ্র এসব মানুষ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, লকডাউনের শুরুতে ত্রাণ দিলেও এখন ত্রাণ দেওয়ার পরিমাণ কমে গেছে। ঢাকায় যতই দিন যাচ্ছে ততই এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কোথাও প্রাইভেট কার বা ট্রাক-পিকআপ থামতে দেখলেই সাহায্য প্রত্যাশীরা সাহায্যের আশায় ছুটে যাচ্ছেন। কেউ ত্রাণ চায় তো কেউ টাকা। কোথাও মানুষ দেখলেই তাকে ঘিরে ধরেন। মিরপুর ইসিবি ক্যান্টিন মোড়ে গতকাল বিকালে ফল কিনতে যাওয়ার সময় জাহাঙ্গীর কবির নামের এক ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন বয়সী ১০-১২ জন নারীর একটি দল ঘিরে ধরে। তার কাছে সাহায্যের আবেদন করে। এড়িয়ে যেতে চাইলেও জাহাঙ্গীরের কাছে প্রত্যেককে ১০ টাকা করে দেওয়ার দাবি জানান সেই দলটি। অতঃপর অনেকটা বাধ্য হয়ে তাকে দলটিকে টাকা দিতে হয়।

ঢাকা সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ তালিকা করে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতি ওয়ার্ডে ৫০০ জনকে সরকারি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে ভোটার না হওয়ায় ভাসমান, গৃহকর্মী ও ছিন্নমূল মানুষদের অনেকেই ত্রাণ পাননি।

সর্বশেষ খবর