সোমবার, ৪ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
সরেজমিন যশোর-নরসিংদী

সবজিচাষিরা অসহায় ক্রেতা নেই বাজারে

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর ও নরসিংদী প্রতিনিধি

সবজিচাষিরা অসহায় ক্রেতা নেই বাজারে

নরসিংদীতে সবজি বাজারে নেই ক্রেতা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে করুণ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন যশোর ও নরসিংদীর সবজিচাষিরা। শত শত মণ সবজির উৎপাদন হলেও তা কেনার মানুষ নেই। এখন পাইকাররাও সবজিচাষিদের কাছ থেকে সবজি কিনছেন না। সবজি বিক্রি হচ্ছে পানির দামে। যশোর সদর উপজেলার চূড়ামনকাটি এলাকার চাষি কাশেম আলী চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে ২৩ কাঠা জমিতে পটোল এবং দুই বিঘা জমিতে কুমড়ার চাষ করেছেন। মূলত রোজার মধ্যে বাজারে পটোল, কুমড়া তোলাই তার উদ্দেশ্য ছিল। এর আগেই পৃথিবীজুড়ে শুরু হয়ে যায় করোনা মহামারী। এর মধ্যে বেশ কয়েক দফা ফসল হাটে উঠিয়েছেন। কিন্তু সেসব ফসল পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে হয়েছে মন-খারাপ-করা দামে। কাশেম আলী বলেন, অন্যবার এই সময়ে পটোল ৬০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। এবার এর দাম ২৫ টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। মিষ্টিকুমড়ার মতো সবজি একরকম বিনামূল্যেই পাইকারদের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। ৫-৬ টাকা কেজি দিয়েও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। চূড়ামনকাটি এলাকার আরেক কৃষক রুহুল আজিজ এবার তিন বিঘা জমিতে পটোল এবং সাত বিঘা জমিতে মিষ্টিকুমড়ার চাষ করেছেন। তার অভিজ্ঞতাও একই রকম। যশোর অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সবজির মোকাম সাতমাইল-বারিনগরে পাইকারদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। অল্প কিছু পাইকার আসছেন, তারা বলছেন, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে লোকসংখ্যা এখন কম। যারা আছেন, তারাও বাইরে খুব একটা বের হচ্ছেন না। ফলে সবজি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা যাচ্ছে না, ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া সবজি পরিবহন করতে গিয়েও গাড়ি পেতে খুব ঝামেলা হচ্ছে। পরিবহনে খরচ অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এবার সবজির উৎপাদন খরচ তুলতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে এ অঞ্চলের সবজিচাষিদের।

যশোর অঞ্চলে শীত-গ্রীষ্ম বারো মাসই অন্তত ২০ রকমের বাহারি সবজির চাষ করে থাকেন চাষিরা। এ জেলার ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ৬ লাখ টন সবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ সবজির অর্ধেকটা দিয়ে যশোর ও আশপাশ এলাকার চাহিদা মেটানো হয়। বাকি অর্ধেকটা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করা হয়ে থাকে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার যশোর অঞ্চলে সব ধরনের সবজির ফলন খুবই ভালো হয়েছে। দুই-তিন সপ্তাহ ধরে হাটে উঠতে শুরু করেছে পটোল, বাঁধাকপি, বেগুন, শিম, টমেটো, লাউ, পেঁপেসহ নানা রকম সবজি। কিন্তু শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক। সবজির ফলনের প্রথম দিকেই সাধারণত দাম পাওয়া যায় ভালো। পরে আস্তে আস্তে দাম পড়ে যায়। কিন্তু এবার প্রথম থেকেই দাম নেই সবজির। সবজিচাষি রুহুল আজিজ বলেন, করোনার কারণে যশোরের সবজিচাষিরা এবার যে রকম বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হলেন, তাতে বড় প্রণোদনা না পেলে আগামী মৌসুমে তাদের পক্ষে সবজি চাষ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সাতমাইল-বারীনগরে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসলেও সবজি মৌসুমে এখানে প্রতিদিনই হাট বসে। কিন্তু এবার হাটের দুই দিনে কিছু সবজি বিক্রি হলেও অন্য দিনগুলোতে ক্রেতাই পাওয়া যাচ্ছে না।

সাতমাইল এলাকার চাষি জয়নাল আবেদীন জানান, শনিবার সাতমাইল হাটে পটোল ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি, মিষ্টিকুমড়ার দাম কিছুটা বেড়ে ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি, বাঁধাকপি ৪ থেকে ৫ টাকা পিস, করোলা ১০ থেকে ১৫ টাকা, বেগুন ৫০ টাকা কেজি, পুঁইশাক ৭ থেকে ৮ টাকা, ঢেঁড়স ১৪ থেকে ১৫ টাকা, লাউ ১৫ থেকে ২০ টাকা, শসা ১৫ থেকে ২০ টাকা এবং বরবটি ১০ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। পাইকাররা বলছেন, গত কয়েক হাটে সবজি কিনে ঢাকা ও হাজীগঞ্জে তাদের কেজিতে ৫-৬ টাকা লসে বিক্রি করতে হয়েছে। এর পরও তারা সবজি কিনছেন ব্যবসা চালু রাখার জন্য।

যশোরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, যশোরে এবার গ্রীষ্মকালীন সবজির প্রচুর উৎপাদন থাকলেও পরিবহন সংকটসহ নানা কারণে সবজির দাম পাচ্ছেন না কৃষক। বিশেষ করে পটোল, করোলা, বেগুনের সরবরাহ খুবই ভালো। কিন্তু রোজার সময় বেগুনের দামটা একটু ভালো পেলেও লোকাল মার্কেটে অন্য কোনো সবজির তেমন দাম পাচ্ছেন না চাষিরা।

এদিকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে নরসিংদীর পাইকারি সবজির বাজারগুলোতে ক্রেতা না থাকায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ক্রেতার অভাবে ব্যাপক দরপতন ঘটেছে পাইকারি সবজির বাজারগুলোতে। গণপরিবহন সংকটের কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতারা আসছেন না সবজির বাজারে। এতে বাজারে সবজি বিক্রি করতে গিয়ে রিকশা-ভ্যানের ভাড়াও ওঠাতে পারছেন না কৃষকরা। সবজির উৎপাদন খরচ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন শুরু হয়েছে কৃষকদের। কৃষক ও কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নরসিংদী জেলার শাকসবজির খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। এখানকার উৎপাদিত শাক-সবজির প্রায় ৭০ ভাগই সরবরাহ করা হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে পাইকারি সবজির বাজার বেলাবো উপজেলার বারৈচা, নারায়ণপুর, রায়পুরার জঙ্গি শিবপুর, শিবপুর উপজেলা সদর, সিঅ্যান্ডবি বাজার, পালপাড়া বাজারসহ সবজির সব পাইকারি বাজারে কমে গেছে পাইকারি ক্রেতা।

করোনাভাইরাস আতঙ্ক ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় পাইকারি ক্রেতার অভাবে বিক্রি করা যাচ্ছে না উৎপাদিত সবজি। স্থানীয়ভাবে আসা ক্রেতাদের কাছে কিছু সবজি বিক্রি করা গেলেও এসব সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা। এতে উৎপাদিত সবজি বাজারে পৌঁছাতে রিকশা-ভ্যানের যে খরচ হয়, তাও তুলতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন একাধিক কৃষক।

সরেজমিন বেলাবো উপজেলার বারৈচা ও নারায়ণপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আশপাশের প্রায় ২০ গ্রাম থেকে রিকশা ও ভ্যানে বোঝাই করে শিম, বেগুন, মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, ধনিয়াপাতা, শসাসহ বিভিন্ন সবজি বিক্রির জন্য নিয়ে হাজির কৃষকরা। বাজারে প্রচুর সবজি উঠলেও ক্রেতা একেবারে কম। বাজারে প্রতি মণ বেগুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায়, শিম বিক্রি হচ্ছে ২২১ টাকা মণ, শসা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা মণ। এ ছাড়া ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না ডাঁটা, লাউ, মিষ্টিকুমড়াসহ অন্যান্য সবজির। করোনা পরিস্থিতিতে সবজির বাজারে দরপতন ঘটায় হতাশায় পড়েছেন কৃষকরা।

বেলাবো উপজেলার হোসেননগর গ্রামের কৃষক জাকারিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবজি বিক্রির জন্য সকাল ৮টায় বারৈচা বাজারে আসি। অথচ সকাল গড়িয়ে দুপুর ১২টা বেজে গেলেও এখনো সব সবজি বিক্রি করতে পারিনি। সবজি বিক্রি করতে না পারলে সংসার নিয়ে খাব কী? সার, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণ কিনব কীভাবে?’ হোসেন নগর গ্রামের চাষি আমির আলী ও মোবারক মিয়া বলেন, ‘আমরা দুই বিঘা জমিতে শিম আবাদ করেছি। বর্তমানে শিমের বাজারদর এত কম, যা দিয়ে শ্রমিক খরচ ও ভ্যান ভাড়াও দিতে পারি না। এ কারণে জমিতে যাওয়া ও পরিচর্যা বন্ধ করে দিয়েছি। ফলে খেতের বেগুন ও শিম খেতেই নষ্ট হচ্ছে।’ রায়পুরা উপজেলার মরজালের গ্রামের কৃষক লিটন বলেন, ‘বেগুন ২০০ টাকা মণ ও শিম ২২০ টাকা মণ দর কষে আর বাড়ছেন না কেউ। এক মাস আগেও বেগুন বিক্রি করেছি ৭০০ টাকা মণ ও শিম বিক্রি করেছি ৯০০ টাকা। এ দামে বিক্রি করলে রিকশাভাড়াও পাব না।’

বারৈচা ও নারায়ণপুর বাজার থেকে সবজি ক্রয় করে  রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিক্রি করেন মো. রইছ মিয়া। তিনি বলেন, ‘পরিবহন না পাওয়ায় এবং সবজির দাম কমে যাওয়ায় অব্যাহত লোকসানে পড়ে সবজি কেনা বন্ধ করে দিয়েছি। করোনার প্রাদুর্ভাব কেটে গেলে আবার এ ব্যবসা শুরু করব।’ বেলাবো উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নাজিম উর রউফ খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘করোনার পরিস্থিতির কারণে সবজির বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তবে অচিরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র মানুষের জন্য বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি করোনার প্রাদুর্ভাব কেটে গেলে সবজির বাজার আবার ভালো হবে।’

সর্বশেষ খবর