মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

মৃত্যু ও আক্রান্তের গতি কমেছে বিশ্বে

প্রতিদিন ডেস্ক

মৃত্যু ও আক্রান্তের গতি কমেছে বিশ্বে

বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা গত রবিবার ২৪ ঘণ্টায় তিন হাজার বেড়ে মোট দুই লাখ ৪৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অবশ্য আগের দিন ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ছিল পাঁচ হাজার। দেখা যাচ্ছে এই হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা দুই হাজার কমেছে। পাশাপাশি রবিবার নতুন আক্রান্ত ছিল আগের দিনের চেয়ে কম। সব মিলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৩৬ লাখ ছাড়িয়েছে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১৮৭টি দেশ ও অঞ্চল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬৯ হাজার জনের। যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা স্পেনে। সে দেশে ২ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি মানুষের মধ্যে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ২৫ হাজার ২৬৪ জনের। আবার মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরের অবস্থানে রয়েছে ইতালি। দেশটিতে করোনা আক্রান্ত হয়ে ২৮ হাজার ৮৮৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আর আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ১০ হাজার ৭১৭ জন। ফ্রান্সে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫২৫ জন। মৃতের সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। যুক্তরাজ্যেও করোনায় মৃতের সংখ্যা সাড়ে ২৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪২ জন। জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯৩ জন। আর মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের।

দৈনিক মৃত্যুর হার কমছে ফ্রান্স, স্পেন, ইতালিতে : মধ্য-মার্চের পর থেকে রেকর্ড করা নতুন মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে কম হয়েছে ফ্রান্সে। প্রথমদিকে শুধু হাসপাতালগুলোতে মারা যাওয়া রোগীদের রেকর্ড রাখা হলেও পরে কেয়ার হোমগুলোতে মারা যাওয়া  রোগীদের রেকর্ড রাখাও শুরু হয়। কয়েকদিন ধরে সব মিলিয়েই দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এ অবস্থায় ১১ মে লকডাউন তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে ফ্রান্স। এদিন থেকে শিশুরা পর্যায়ক্রমে স্কুলে ফিরতে শুরু করবে, কিছু ব্যবসা ফের চালু হবে এবং কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই লোকজন তাদের বাড়ি থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারবেন। রবিবার দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী অলিভিয়ের ভেরন জানান, এসব সিদ্ধান্ত নতুন আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার ওপর নির্ভর করছে, বিশেষ করে প্যারিস অঞ্চল ও উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের মতো সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকাগুলোর পরিস্থিতির ওপর।

এদিকে স্পেনে রবিবার দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ১৬৪ জন ছিল, যা দেড় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং আগের দিন শনিবারের সংখ্যা থেকে শতাধিক কম। সাত সপ্তাহ পর শনিবার থেকে দেশটিতে প্রাপ্তবয়স্কদের বাইরে গিয়ে ব্যায়াম করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে ১৪ বছরের নিচের শিশুদের জন্য লকডাউন শিথিল করা হয়। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী সানচেজ বলেছেন, তার দেশ এখন লকডাউনের সময়কার ত্যাগের পুরস্কার পাচ্ছে। ইউরোপের কঠোরতম লকডাউনের মধ্যে স্পেনেরটি অন্যতম ছিল। গতকাল থেকে দেশটিতে গণপরিবহনে মাস্ক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেলুনের মতো কিছু ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সীমিত পরিসরে ব্যবসা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে দুই মাস আগে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে রবিবার করোনাভাইরাসজনিত দৈনিক মৃত্যুর সর্বনিম্ন সংখ্যা লিপিবদ্ধ করেছে ইতালি। দেশটিতে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রোগীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়া অব্যাহত আছে। গতকাল থেকে দেশটিতে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। এদিন থেকে ইতালিয়ানরা সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনে বাইরে গিয়ে ব্যায়াম করতে পারছেন। তারা নিজ অঞ্চলের মধ্যে থাকা আত্মীয়দেরও দেখতে যেতে পারছেন, কিন্তু বন্ধুদের নয়। তবে স্কুল, সিনেমা ও অধিকাংশ দোকান বন্ধই থাকবে। জুন থেকে ক্রেতারা বার ও রেস্তোরাঁগুলোর টেবিলে বসতে পারবেন।

সংকটজনক পর্যায়ে রাশিয়া : কভিড-১৯ এ রাশিয়ায় দৈনিক মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়েছে। সে দেশে নতুন করে করোনা-আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরই কোনো উপসর্গ নেই। সব মিলিয়ে সংক্রমিত ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৮৭ জন। আক্রান্তের সংখ্যা সর্বাধিক রাজধানী মস্কোতে। সেখানে প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন প্রায় ১৭০০ জন। গত রবিবার ২৪ ঘণ্টায় আরও ৫৭ জনের মৃত্যু হওয়ায় দেশে মৃতের সংখ্যা মোট দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৮০ জন। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রুখতে মার্চের শেষ থেকে আংশিক লকডাউন জারি করেছে রাশিয়া। মস্কোয় বিশেষ অনুমতি ছাড়া সর্বত্র ঘোরাফেরা করতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। শুধু জিনিস কিনতে, কুকুরকে হাঁটাতে ও আবর্জনা ফেলার জন্য বাইরে বেরোতে পারছেন তারা। এর মধ্যেই সংক্রমণের মাত্রা বাড়ায় শনিবার মস্কোবাসীকে স্বেচ্ছা-নিভৃতবাসে থাকার আবেদন জানিয়েছেন শহরের মেয়র। ব্লগেও তিনি লিখেছেন, ‘করোনার ভয়াবহতা আরও বাড়ছে।’ পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে শহরের বুকে ঘোরাফেরা করার জন্য দেওয়া ডিজিটাল পারমিটের সংখ্যা আরও কমানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

যে সাত দেশে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে : যে সাতটি দেশে মৃত্যু ও সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে তার শীর্ষে আছে ব্রাজিল। ওই অঞ্চলের মেক্সিকো, ইকুয়েডর ও পেরুতেও একই অবস্থা। এ ছাড়া কানাডা, রাশিয়া ও ভারতে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। ব্রাজিলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এখন এক লাখ ছুঁইছুঁই। প্রতিদিন রোগী শনাক্ত হচ্ছে পাঁচ-ছয় হাজার করে। গত পাঁচ দিনে দুই দিন দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ৫২০ এবং রবিবার ৫০৯ জনের মৃত্যু হয়। অন্য তিন দিনের মধ্যে শুক্রবার মারা যান ৪৪৮, শনিবার ৩৯০ এবং সোমবার ৩৪০ জন। সব মিলিয়ে মৃত্যুর সংখ্যায় বিশ্বে দেশটি এখন ৮ নম্বরে। দেশটিতে মোট মারা গেছেন ৬ হাজার ৭০০ এরও বেশি মানুষ।

লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ পেরুতেও সংক্রমণ বাড়ছে। দৈনিক রোগী শনাক্ত হচ্ছে গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজারের বেশি। আর গত পাঁচ দিনে মৃত্যু হচ্ছে ৭০ জনের বেশি করে। এর মধ্যে গত শনিবার মৃত্যু হয়েছে ১০৮ জনের। সব মিলিয়ে দেশটিতে প্রায় ৪৩ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছেন। মৃত্যু ১ হাজার ২০০ ছাড়িয়েছে।

পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে এই অঞ্চলের আরেক দেশ ইকুয়েডরে। মৃত্যু দেড় হাজার ছুঁইছুঁই। আক্রান্ত ৩০ হাজারের মতো। সেই অর্থে অন্য দেশগুলোর তুলনায় খুব বেশি মনে না হলেও গত পাঁচ দিনেই মারা গেছেন ৯০০-এর বেশি মানুষ।

পরিস্থিতি ধারাবাহিকভাবে খারাপ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী কানাডায়ও। দেশটিতে গত এক মাসের প্রথম ১৫ দিন দৈনিক এক হাজারের বেশি এবং শেষ ১৫ দিন দৈনিক দেড় হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আর মৃত্যুও গত ২০ দিনে কোনো দিন একশর নিচে নামেনি। বেশির ভাগ দিন ছিল দেড়শর পাশাপাশি, একদিনে তা দুইশও ছাড়িয়েছে। গত শনিবারও মারা গেছেন ১৭৫ জন। তার আগের দিন ২০৭ জন। সব মিলিয়ে কানাডায় মৃত্যু সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। রোগী শনাক্ত হয়েছেন প্রায় ৫৭ হাজার।

মেক্সিকোয় মৃত্যু ২ হাজার ছাড়িয়েছে গত রবিবার। এর মধ্যে ১০ দিন ধরে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন একশর বেশি মানুষ। দেশটিতে সংক্রমিত রোগী আছেন ২১ হাজারের বেশি। একদিনে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছেন শনিবার ১ হাজার ৫১৫ জন। সংক্রমণ ও মৃত্যু দ্রুত বাড়ছে ভারতেও। এনডিটিভি জানায়, দেশটিতে শনিবার দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ১০০ জন হয়। রবিবারও মৃত্যু হয়েছে ৮৩ জনের। দেশটিতে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৩০০-এর বেশি রোগীর। শনাক্ত হওয়া সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ৪০ হাজার ছুঁইছুঁই।

অ্যামাজনে খোঁড়া হচ্ছে গণকবর : ব্রাজিলের অ্যামাজন বনের মধ্যে অবস্থিত সবচেয়ে বড় শহর মানাউশে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে করোনা সংকট। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চলা ওই শহর কর্তৃপক্ষকে খুঁড়তে হচ্ছে গণকবর। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্রাজিলে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দেশটির অ্যামাজোনাস প্রদেশের রাজধানী মানাউশ হতে যাচ্ছে পরবর্তী গুয়াকুইল। সম্প্রতি ইকুয়েডরের ওই শহরের রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে করোনায় আক্রান্তদের মৃতদেহ।

ব্রাজিলে করোনা সংক্রমণে সামনের সারিতে রয়েছে অ্যামাজোনাস। স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকেও রয়েছে অনেক পিছিয়ে। সব মিলিয়ে করোনা অ্যামাজনের মাঝে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। এপ্রিলে মানাউশে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে মৃত্যুর হার ৫৭৮% বেড়ে যায়। তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে করোনা রোগী বলে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন মত দিচ্ছেন। কারণ এখানে করোনা পরীক্ষার হার খুবই কম, তাই প্রকৃত সংখ্যা জানার উপায় নেই। মানাউশ ব্রাজিলের সপ্তম বড় শহর, জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। প্রায় বিচ্ছিন্ন এই শহরে অনেক অদিবাসীও বসবাস করেন। দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও স্থানচ্যুতি মিলিয়ে করোনা তাদের অবস্থা সঙ্গীন করে তুলেছে।

ইরানের ১৩২ জেলায় খুলল মসজিদ : করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় গতকাল ইরানের ১৩২টি জেলার মসজিদ খুলে দেওয়া হয়েছে। যেসব অঞ্চলকে শঙ্কামুক্ত ঘোষণা করে সেখানকার মসজিদগুলোকে খোলার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রুহানি জানান, ১৩২টি জেলা যেখানে করোনা ছড়ানোর শঙ্কা খুব কম সেখানে শুক্রবারে জুমার নামাজ মসজিদে আদায় করতে পারবে ধর্মপ্রাণ মানুষ।

ইরানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে মহামারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ৭৭ হাজার ৩৫০ জন রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। মন্ত্রণালয়ের গণসংযোগ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা কিয়ানুশ জাহানপুর ইরানে করোনাভাইরাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে দেওয়া সংবাদ সম্মেলনে শনিবার এ তথ্য জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর