বুধবার, ৬ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

হাসপাতালে যাচ্ছে না সাধারণ রোগীরা

করোনা আতঙ্ক ও চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার কারণ, সাধারণ টেস্টগুলোও অনেকটা বন্ধ, ভিড় শুধু করোনা হাসপাতালগুলোতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাসপাতালে যাচ্ছে না সাধারণ রোগীরা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করোনা ইউনিটে গতকাল রোগী নিয়ে ব্যস্ততা -জয়ীতা রায়

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে হাসপাতালে যাচ্ছে না সাধারণ রোগী। অন্য সময় নির্ধারিত বেডের অতিরিক্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও এখন পুরোপুরি বিপরীত চিত্র। সাধারণ সময়ে যেসব হাসপাতালে ভর্তির জন্য ধরনা দিতে হতো এখন সেখানে ফাঁকা বেড পড়ে আছে। দেশের বড় বড় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের সর্বত্র প্রায় একই চিত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগী ও চিকিৎসক সবার মধ্যে থাকা করোনা আতঙ্কই হাসপাতালগুলোর এ পরিস্থিতি। অনেক হাসপাতালে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট থাকলে রোগীই নেওয়া হচ্ছে না। আর বেশির ভাগ হাসপাতালে করোনা নেই এমন সার্টিফিকেট ছাড়া সাধারণ রোগগুলোর রোগীদেরও ভর্তি নেওয়া হয় না। চিকিৎসাসেবাই শুধু নয়, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সাধারণ টেস্টগুলোও প্রায় বন্ধের উপক্রম। ভিড় শুধু করোনা হাসপাতালগুলোয়।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাসপাতালগুলোয় আগে রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হতো। অথচ এখন প্রায় রোগীশূন্য। লকডাউনের কারণে রোগীরা আসতে পারছে না। আবার এলেও প্রয়োজনীয় সেবাটা অনেক সময় তারা পাচ্ছে না। হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে রোগী মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। করোনার কারণে অনেক সময় চিকিৎসকরাও ভয় পাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে হৃদরোগ, কিডনি রোগে ভুক্তভোগী রোগীরা।’

জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) শয্যা রয়েছে ১ হাজার ৯০৪টি। বর্তমানে হাসপাতালটির ইনডোর-আউটডোর দুই বিভাগেই রোগীর সংখ্যা অনেক কম। আগের তুলনায় ৪৫ শতাংশ রোগী কমে গেছে সেখানে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিত্র একই। হাসপাতালটিতে ২ হাজার ৬০০ শয্যা রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে এ হাসপাতালে শয্যার অতিরিক্ত অনেক রোগী ভর্তি থাকত। বর্তমানে সেখানেও রোগীর সংখ্যা মাত্র ৫০০। একই অবস্থা আজিমপুর মা ও শিশু হাসপাতালেও। এ হাসপাতালে ৩৭০ শয্যার বিপরীতে বর্তমানে ৪২ জন গাইনি বিভাগে ও ৫৫ জন শিশু বিভাগে ভর্তি রয়েছে। শুধু সরকারি হাসপাতাল নয়, ঢাকার ব্যবসাসফল বেসরকারি হাসপাতালগুলোরও একই চিত্র। রাজধানীর পান্থপথে অবস্থিত স্কয়ার হাসপাতালে ৪০০ শয্যা রয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে মাত্র ১৫০ জন রোগী ভর্তি আছে। ফাঁকা রয়েছে ২৫০ শয্যা। প্রতিদিন হাসপাতালটির বহির্বিভাগে গড়ে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিত। করোনাভাইরাসের কারণে গত কয়েকদিনে এ সংখ্যা ৫৫০-৬০০-তে নেমে এসেছে। রাজধানীর আরেক খ্যাতিসম্পন্ন বেসরকারি হাসপাতাল গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল। ৩৭০ শয্যার বিপরীতে এখানে বর্তমানে ১৫০ জন রোগী ভর্তি আছে। ফাঁকা আছে ২২০টি। তা ছাড়া বহির্বিভাগে সেবা নেওয়া রোগীর সংখ্যাও ব্যাপকহারে কমে গেছে। রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ৩৫০টি। বর্তমানে সেখানে মাত্র ৫৫-৬০ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। ঢাকার অন্যতম নামকরা বিশেষায়িত হাসপাতাল ধানমন্ডির ল্যাবএইড। হাসপাতালটিতে ২৭৫টি শয্যা থাকলেও বর্তমানে এর মাত্র ২৫ শতাংশে রোগী আছে। বাকিগুলো ফাঁকা। বহির্বিভাগে সেবা নেওয়া রোগীর সংখ্যাও কমে গেছে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গনি মোল্লা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাধারণত আমাদের হাসপাতালের আউটডোরের দুই ইউনিটে ৬-৭ হাজার রোগী আসত প্রতিদিন। এখন আউটডোরে ১২০ জনের মতো রোগী আসে। ভর্তি রোগী থাকে ৬০০-এর মতো। বর্তমানে রয়েছে ৩৫০ জন। এ ছাড়া প্রতিদিন ২০-২৫ জন রোগী আসে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রেফার্ড হয়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের সেবায় কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। সন্দেহভাজন রোগীদের জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্দেহ হলে আমরা করোনা টেস্ট করার ব্যবস্থা করছি। এখন পর্যন্ত কোনো করোনা রোগী আমাদের হাসপাতালে শনাক্ত হয়নি।’ ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোয়ও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগে প্রায় দেড় হাজার রোগী ভর্তি থাকলেও বর্তমানে এ হাসপাতালের অর্ধেক শয্যাই ফাঁকা। বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার হারও ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। সম্পূর্ণ সুস্থ না হলেও করোনা আতঙ্কে রোগীরা চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে যাচ্ছে। খুলনার অন্যান্য হাসপাতালেও রোগীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ১০০ শয্যাবিশিষ্ট বাগেরহাট সদর হাসপাতালের গাইনি, শিশু, মেডিসিন, অর্থোপেডিকসহ বিভিন্ন বিভাগের বেডগুলো রোগীশূন্য। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে হাসপাতালটির চিকিৎসকরা জরুরি সেবা দিচ্ছেন। ১ হাজার শয্যার রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগে আড়াই হাজারের মতো রোগী ভর্তি থাকত। কিন্তু করোনাভাইরাসের আতঙ্কে হাসপাতালটিতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭০০-তে নেমে এসেছে। রংপুর জেলার আট উপজেলা হাসপাতালের অবস্থাও একই। নোয়াখালীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি জেনারেল হাসপাতালে আগে কমপক্ষে ৬০০ রোগী ভর্তি থাকত। বর্তমানে হাসপাতালটি প্রায় ফাঁকা। আগে প্রতিদিন বহির্বিভাগে হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে এলেও বর্তমানে তা ৮-১০ জনে গিয়ে ঠেকেছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহেদুর রহমান খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাধারণত এ হাসপাতালে প্রতিদিন আউটডোরে রোগী থাকে ৭০০-৮০০ জন। এখন আসছে গড়ে ১৫০ জন। হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকে ৬৭০ জন। বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ৩৫০ জন। যানবাহন না থাকায় রোগী আসতে পারছে না। জরুরি রোগী এলে আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি।’ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে অধিকাংশ হাসপাতালের স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। জররি রোগীদের সেবা পেতে পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। করোনা টেস্ট ছাড়া অন্য কোনো টেস্টের জন্য নেই দৌড়ঝাঁপ। অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারই বন্ধ। অল্প কিছু খোলা থাকলেও রোগী আসছে না টেস্ট করাতে। হাসপাতাল করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। এজন্য সাধারণ সমস্যায় রোগীরা আসছে না। কিন্তু অতীব প্রয়োজনে এলেও মিলছে না সেবা। হাসপাতালে ঘুরে মারা যাওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। করোনা সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে মানুষের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের দরজায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে টেস্ট করতে আসা মানুষের ভিড় গিয়ে থামে শাহবাগ মোড়ে। অন্য হাসপাতালগুলোর অবস্থাও একই। সব উপসর্গ নিয়ে বাসায় টেস্টের অপেক্ষায় দিন গুনছে অনেকে। একই অবস্থা ঢাকার বাইরেরও। রাজশাহীতে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক কাজী শাহেদ জানান, করোনা অজুহাতে ভেঙে পড়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা। করোনা আক্রান্ত রোগীর কাছে যান না চিকিৎসক। সাধারণ রোগীরাও পাচ্ছে না সেবা। আগে যেখানে হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে ফ্লোরে রোগী দেখা যেত, এখন সেখানে রোগী নেমে এসেছে অর্ধেকে। ১ হাজার শয্যার এ হাসপাতালটিতে এখন গড়ে রোগী ভর্তি থাকছে ৫০০ থেকে ৫৫০ জন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে যখন সাধারণ মানুষের বহু প্রশ্ন, তখন হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফজলে হোসেন বাদশা বলছেন, চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় সবকিছু করা হয়েছে। চিকিৎসা না দেওয়ার কোনো অজুহাত নেই। চট্টগ্রামে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক রেজা মুজাম্মেল জানান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে সাধারণত প্রায় ৩ হাজার রোগী ভর্তি থাকে। এই সময়ে গড়ে রোগী ভর্তি আছে ১ হাজার ২০০ জন। অর্থোপেডিক বিভাগে দৈনিক ৪০-৫০টি পর্যন্ত অপারেশন হলেও এখন হচ্ছে ৮-১০টি। সার্জারি বিভাগে দৈনিক ২৫-৩০টি অপারেশন হলেও এখন হচ্ছে ৪-৫টি। করোনাভাইরাস প্রকোপে হাসপাতালে রোগীর হার ৭০ শতাংশ কমে গেছে। চট্টগ্রামে বন্ধ চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার। চমেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালে বর্তমানে সাধারণ রোগী কমলেও সর্দি-কাশি-জ্বরের রোগী আছে। জরুরি চিকিৎসা ছাড়া কেউ এখন হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছেও যাচ্ছে না। তা ছাড়া হাসপাতালের ফ্লু কর্নার থেকেও অনেকে চিকিৎসা ও পরামর্শ নিয়ে চলে যাচ্ছে।’

হাসপাতালের বহির্বিভাগের টিকিট বিক্রেতা মো. কাইয়ুম বলেন, ‘সাধারণ সময়ে দৈনিক ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টিকিট বিক্রি হলেও এখন ৭০০-৮০০-এর মতো বিক্রি হচ্ছে। হাসপাতালে রোগী ভর্তিও কম। করোনা আতঙ্কে রোগীরা আসছে না।’ আমাদের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি সৈয়দ নোমান জানান, করোনাভাইরাসের আতঙ্কের কারণে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আন্তবিভাগে প্রায় ৭০ শতাংশ রোগী কমে গেছে। সাধারণত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন আউটডোর, ইনডোর ও ওয়ানস্টপ সার্ভিস মিলে গড়ে ৯ হাজার রোগী চিকিৎসাসেবা নিত। ময়মনসিংহ মেডিকল কলেজের সহকারী পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম জানান, গতকাল বহির্বিভাগে মাত্র ৩০৪ জন এসেছিল চিকিৎসা নিতে। অন্যদিকে আন্তবিভাগে ভর্তি আছে ৮০০-এর বেশি রোগী।

সর্বশেষ খবর