বুধবার, ৬ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার প্রথম ধাক্কা সামলিয়ে স্বাভাবিকতার চেষ্টায় বন্দর

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

করোনার প্রথম ধাক্কা সামলিয়ে স্বাভাবিকতার চেষ্টায় বন্দর

করোনার প্রথম ধাক্কা সামলিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের অর্থনীতির হৃৎপি- বলে খ্যাত এ বন্দরে করোনার কারণে গত এপ্রিলে সবচেয়ে কম কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও ডেলিভারি হয়েছে। তবে চলতি মে মাসে বন্দরকে স্বরূপে ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন দিন দিন পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে বলে জানান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। শনিবার এক দিনে জাহাজ থেকে ৮ হাজার ৪২০ কনটেইনার ওঠানামা হয়েছে। গত ৩৮ দিনে এটা ছিল সর্বোচ্চ। বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনার রাখার সুযোগ তৈরি হওয়ায় এক দিনে এই সর্বোচ্চসংখ্যক কনটেইনার ওঠানো-নামানো সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

করোনা পরিস্থিতির কারণে টানা প্রায় দেড় মাস থমকে ছিল চট্টগ্রাম। এ সময় কনটেইনার আর জাহাজ জটে পড়ে দেশের এই প্রধান বন্দর। জট কমানোর জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ৪ মে পর্যন্ত সব ধরনের কনটেইনারের স্টোর রেন্ট শতভাগ মওকুফ করে। এতে কনটেইনার ডেলিভারিতে গতি ফিরে আসে। বিজিএমইএসহ দেশের প্রধান ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ সুযোগ তৃতীয়বারের মতো ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এখন স্বাভাবিক সময়ের মতোই বন্দরের ইয়ার্ড থেকে ডেলিভারি হচ্ছে গড়ে প্রতিদিন ৪ হাজার ৫০০ টিইইউস (টোয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস) পণ্যবাহী কনটেইনার, হ্যান্ডলিং হচ্ছে ৬ হাজারের বেশি টিইইউস কনটেইনার। বন্দরের এই স্বাভাবিক রূপে ফেরাতে ব্যবসায়ীদের বন্দর স্টোর চার্জ মওকুফ করতে হয়েছে প্রায় ১৩৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া অফডকে সব ধরনের কনটেইনার ডেলিভারির সুযোগসহ আরও অনেক পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।

তৃতীয় দফায় আবারও কনটেইনারের স্টোর রেন্ট শতভাগ মওকুফের সুযোগ দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১৬ মের মধ্যে পণ্য খালাস নেওয়া হলে এ ছাড় পাবেন ব্যবসায়ীরা। এই সময়ের মধ্যে খালাস নেওয়া না হলে দন্ডভাড়া আরোপ হবে বলেও জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ছুটি ঘোষণার চার দিন আগের কনটেইনারও এ সুবিধা পাবে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। প্রথম দফায় ২০ এপ্রিল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় দফায় ৪ মে পর্যন্ত কনটেইনার রাখার ভাড়ায় ছাড় দেওয়া হয়। এবার মিলে দেড় মাসের বেশি সময় এ সুবিধা পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, সাধারণ ছুটি বাড়ানোর কারণে কনটেইনার রাখার ভাড়ায় ছাড়ের সময় বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যাতে এ সুবিধা নিয়ে দ্রুত পণ্য খালাস করেন, সেজন্য আহ্বান জানাই। কারণ পণ্য খালাস হলে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো সহজ হবে।

স্বাভাবিক সময়ে জাহাজ থেকে নামানোর পর চার দিন পর্যন্ত বিনা ভাড়ায় কনটেইনার রাখা যায় বন্দরে। এরপর প্রথম ধাপে প্রতিটি কনটেইনারে ৬ ডলার, দ্বিতীয় ধাপে ১২ ডলার এবং শেষ ধাপে ২৪ ডলার করে ভাড়া দিতে হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ ছাড়ের সুবিধা দেওয়ায় সময়ভেদে একেকটি কনটেইনারে সর্বোচ্চ ৪০-৫০ হাজার টাকা ছাড় পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

বন্দরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, দুই পদক্ষেপে কনটেইনার খালাসের হার বাড়ায় আগের চেয়ে বন্দরের কার্যক্রম বেড়েছে। একটা হচ্ছে স্টোর রেন্ট মওকুফ ও অন্যটি অফডকে পণ্য খালাসের অনুমোদন। বন্দরের যে সক্ষমতা রয়েছে, তা পুরোপুরি কাজে লাগানোর পথ একটি, তা হলো পণ্য খালাসের হার বাড়ানো। ব্যবসায়ীদের যেমন বন্দর চত্বর থেকে পণ্য খালাসের হার বাড়াতে হবে, আবার ডিপোতেও কনটেইনার সরিয়ে নেওয়ার হার বাড়াতে হবে।

বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বন্দরের কার্যক্রম পুরোদমে স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। করোনা ধাক্কার পাশাপাশি সামনে ঈদের ছুটির সময় পণ্য খালাস কমে আবারও কনটেইনারজট তৈরি হতে পারে। আবার বর্ষা মৌসুমে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকলে বৃষ্টিতে বন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

এ প্রসঙ্গে বন্দর ব্যবহারকারী ফোরামের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বন্দর যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তা খুবই ইতিবাচক। এসব পদক্ষেপের কারণে বন্দরের চাকা ঘুরছে। তবে এখন ব্যবসায়ীদের পণ্য খালাসের হার বাড়াতে হবে। পণ্য খালাস না করলে ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমন বন্দরও সমস্যায় পড়বে। কনটেইনার ডেলিভারির ক্ষেত্রে এখন যে গতি ফিরে এসেছে তা দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ধরে রাখতে হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হতো। বর্তমানে সেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। এ অবস্থা ধরে রাখতে আমদানিকারক এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সচল ও সতর্ক থাকতে হবে।

এদিকে বন্দরের কার্যক্রমে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে সচল করা হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কার্যক্রমও। ইয়ার্ড থেকে রমজানের প্রায় ২ হাজার ৫০০ কনটেইনার পণ্য ডেলিভারি নিতে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বরাবর চিঠি দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। গেল সপ্তাহে বন্দরের সার্বিক পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে আসেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বন্দর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানান, গত ২৫ এপ্রিল কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছে ২ হাজার ২৩৯টি, ২৬ এপ্রিল ২ হাজার ৭১৪টি, ২৭ এপ্রিল ২ হাজার ৭৯৩টি, ২৮ এপ্রিল ২ হাজার ৭৫৩টি, ২৯ এপ্রিল ৪ হাজার ৪৪০টি এবং ৩০ এপ্রিল ৪ হাজার ২৪২টি। এভাবে পুরো এপ্রিলে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৯২১ টিইইউস। মাস হিসেবে যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মার্চের তুলনায় এপ্রিলে কমেছে প্রায় ৪৭ শতাংশ হ্যান্ডলিং।

সর্বশেষ খবর