বুধবার, ৬ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

এক্সট্রাকশন : হলিউড বাণিজ্যের বলি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি!

সারওয়ার রানা

এক্সট্রাকশন : হলিউড বাণিজ্যের বলি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি!

অস্ত্র, মাদক ব্যবসা আর গ্যাংস্টার সংস্কৃতিকে বিবেচনায় নিয়ে যদি কোনো দেশের খুন বা হত্যার হার নির্ণয় করা হয় তাহলে জাতিসংঘ প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী জনসংখ্যা অনুপাতে যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি সে দেশগুলোর ধারেকাছেও নেই বাংলাদেশ। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে অন্য মহাদেশে অবস্থিত সেসব দেশে মাদকসম্রাটরা হেলিকপ্টার, এয়ারক্রাফট এমনকি সাবমেরিন পর্যন্ত ব্যবহার করে। মাদকের জগতে এসব মহাপ্রতাপশালী সাম্রাজ্য ফেলে সম্প্রতি হঠাৎ হলিউড পরিচালক স্যাম হারগ্রেভের নজর পড়ে বাংলাদেশের ঢাকার ওপর, বানালেন-এক্সট্রাকশন। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্ত হওয়া এ মুভিটি দেখে যে কোনো দর্শক, যিনি কখনো বাংলাদেশে আসেননি, সহজেই নতুন এক মাদক সাম্রাজ্যের সঙ্গে পরিচিত হবেন। বাংলাদেশ নামক এই মাদক গডফাদারদের নিয়ন্ত্রিত সাম্রাজ্যে কঙ্কালসার অর্ধনগ্ন শিশুরা স্কুলে না গিয়ে একে-৪৭ বা অটোমেটিক সাবমেশিনগান নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ঘিঞ্জি বস্তির শহর ঢাকার রাস্তায় পুলিশ, এলিট ফোর্স এমনকি সেনাবাহিনীও মাদক মাফিয়াদের আদেশে মুহুর্মুহু গুলিবিনিময় করে সাধারণ মানুষ হত্যা করার জন্য। সিনেমার এই রূপকথাময় বীভৎস বার্তায় যেন বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে- এ অন্ধকার নৈরাজ্যময় দেশে দুঃস্বপ্নেও কোনো দিন কেউ যেন ভ্রমণ বা বিনিয়োগের কল্পনা না করেন। আর কিছু আত্মসম্মানহীন বাংলাদেশি কুশীলব বাংলাদেশের গায়ে এ কালিমা লেপনকারী প্রযোজনায় জড়িত থাকতে পারার অহংকার প্রকাশ করছেন সোশ্যাল মিডিয়া বা টেলিভিশনের ইন্টারভিউতে। হলিউডি প্রযোজনায় নিজের নাম সংযুক্ত করেছেন বলে কথা, হোক না তা স্বদেশবিদ্বেষী!

গতানুগতিক অ্যাকশনধর্মী এ ছবিটি পরিচালনা করেছেন হলিউডি পরিচালক স্যাম হারগ্রেভ, যা নেটফ্লিক্সে রিলিজ হয় গত ২৪ এপ্রিল। ছবিতে মুম্বাইর এক জেলবন্দী ড্রাগলর্ডের ছেলে অভিকে কিডন্যাপ করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। কিডন্যাপের হোতা ঢাকার আরেক ডাকসাইটে মাদকসম্রাট আমির আসিফ। ছেলেকে উদ্ধারের জন্য নিজের সহযোগী সাজুকে (রণদ্বীপ হুদা) চাপ ও হুমকি দেন মুম্বাইর সেই গডফাদার। এ পরিস্থিতিতে সাজু উদ্ধার অপারেশনের জন্য অস্ট্রেলিয়ান এক মার্সেনারি সোলজার টেইলার (ক্রিস হেমসওয়ার্থ)-কে নিয়োগ দেন অর্থের বিনিময়ে। পরবর্তীতে সাজু আর টেইলার মিলে ব্যাপক সংঘর্ষ- তথা অ্যাকশন, ভায়োলেন্স আর সাসপেন্সের ভিতর দিয়ে অভিকে ঢাকা থেকে উদ্ধার করেন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে। মোটা দাগে এই হচ্ছে ছবির ঘটনা।

ছবিটির গল্পে আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। আর দশটা অ্যাকশন ছবির মতোই এটা দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে এমনকি অ্যান্টি ট্যাঙ্ক অস্ত্র দিয়ে হেলিকপ্টার ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু মুভিটিতে অন্য একটি বিশেষত্ব রয়েছে। তা হলো, ছবিটিতে কাহিনি ও চরিত্র কাল্পনিক হলেও ছবিতে প্রতিফলিত দেশ, দেশের মানুষের জীবনপন্থা, আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলো কাল্পনিক নয়। কোনো দর্শক যার বাংলাদেশ বা ঢাকা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসে যখন এ ছবিটি দেখবেন, তখন এ মুভিতে প্রতিফলিত বাংলাদেশের ভাবমূর্তিই তার মধ্যে স্থায়ী হতে বাধ্য। এ ধরনের একটা অ্যাকশন-প্রধান ছবির পটভূমির জন্য দরকার হয় একটা অপরাধপ্রবণ এলাকা, যেখানে নায়ক এসে একা সব অপরাধ দলিত-মথিত করে নায়িকাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। তো এ ছবিতে অন্য এক ড্রাগলর্ডের রাজপুত্রকে উদ্ধারের জন্য যে অপরাধপ্রবণ এলাকা নির্বাচন করতে হবে সে এলাকাটি কেন ‘ঢাকা’ হিসেবে তাদের বেছে নিতে হবে? কেন অপরাধপ্রবণ হিসেবে স্বীকৃত অন্য কোনো দেশ নয়? কাহিনির কোন বিশেষ প্রয়োজনে এ শহরের নাম ব্যবহার হয়েছে? সেটা কি নেটফ্লিক্সে এ অঞ্চলের সাবস্ক্রাইবার বাড়ানোর কসরত, নাকি অন্য কোনো ষড়যন্ত্র, নাকি পরিচালকের মূর্খতা- সে রহস্য এখনো অনাবিষ্কৃত।

ঢাকাকে চিত্রায়ণের নামে এ শহরের অপচিত্রায়ণই দেখেছেন এর দর্শকরা। আমি জানি, ঢাকা নিয়ে ছবি বানাতে আপনাকে ঢাকায় আসার প্রয়োজন নাই। ড্রোন দিয়ে কয়েকটি মাস্টার শর্ট নিয়ে আহমেদাবাদ বা ব্যাংককে কেন, খোদ ইউনিভার্সাল স্টুডিওতেই সেট ফেলে হলিউডে বসেই ঢাকাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন, বড় বড় পরিচালক তা-ই করে এসেছেন। তা না করে ব্যাংককে সেট ফেলে যে বিপন্ন ঢাকাকে উপস্থাপনা করা হয়েছে, যে লোকালয় ও আবহ তৈরি হয়েছে, যে উচ্চারণে মানুষের কথাবার্তা এসেছে, তাতে বোঝা গেছে যে কেবল ‘ঢাকা’ নামটি ব্যবহার করে একটি রহস্যজনক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই পরিচালক এ ছবিটি বানাতে চেয়েছেন।

ভৌগোলিকভাবেও ঢাকার উপস্থাপনে মারাত্মকভাবে ভুল দেখানো হয়েছে। ছবির শেষের দিকের অ্যাকশন দৃশ্যে পুরান ঢাকার কাছের এক ব্রিজকে বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারে দেখানো হয়েছে যা ঢাকাকে বর্ডারের খুব কাছের শহর বলে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। সরু গলি, রংচটা গাড়ি, ড্রাগ মাফিয়া, খোলামেলা নাইট ক্লাবে অর্ধনগ্ন নর্তকীদের নৃত্য, কিডন্যাপিং, খোলা রাস্তায় গানফাইট- এসব দিয়ে ঢাকার যে আবহ তুলে ধরা হয়েছে তা কোনোভাবেই আমাদের ঢাকা নয়, এ এক অপরিচিত ঢাকা। আমরা জানি, পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন অনেক ড্রাগলর্ড বা মাদকসম্রাট আছেন যারা সেসব দেশে পুলিশ, স্পেশাল ফোর্স বা এলিট ফোর্স, সেনাবাহিনী এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন। ঠিক সেই মডেলটিই স্যাম হারগ্রেভ তার ‘এক্সট্রাকশন’ ছবিতে ঢাকার ওপর আপাতদৃষ্টিতে সুপারইমপোজ করেছেন বলে মনে হয়। যার ফলে পুরো ছবিটিই রূপ নিয়েছে এক অবাস্তব ও অসংলগ্ন কাহিনি হিসেবে। বাংলাদেশ বা ঢাকার ফোর্সগুলোর সাংগঠনিক সংস্কৃতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত পড়াশোনা বা গবেষণা না থাকার কারণেই এমন বেখাপ্পা চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।

ছবিতে ঢাকার ড্রাগলর্ড আসিফের সঙ্গে কথিত কর্নেলের যে সম্পর্ক দেখানো হয়েছে তা হাস্যকর ও অবাস্তব। এখানে দেখি, ষাট ছুঁইছুঁই সাদা দাড়িওয়ালা এক কর্নেলকে একজন মাফিয়া অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে পুরো ঢাকা লকডাউন করে দেওয়ার আদেশ দেয়। ড্রাগলর্ডের আদেশে একটি শিশুকে কিডন্যাপ করতে সহায়তা করার জন্য ঢাকার রাস্তায় প্লাটুন প্লাটুন পুলিশ, এলিট ফোর্স এমনকি সেনাবাহিনীও অত্যাধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ, এপিসি, হেলিকপ্টারসহ এসে সয়লাব হয়ে গেছে। ভিনদেশি একজন মার্সেনারি তাদের পাখির মতো গুলি করে মারছে। মার্সেনারির সহায়তায় পাঠানো হয়েছে একটি জাহাজ, যদিও জাহাজটি আসলে কোথায় নোঙর করা হয়েছিল তা বোঝা মুশকিল। ওই জাহাজের আশপাশে নীরব বনভূমি আর টলটলে নদীর পানি দেখা গেলেও সেখান থেকে কিছুক্ষণ হাঁটলে বা দৌড়ালে পাওয়া যায় পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি বসতি এলাকা যেখানে মানুষের ঘরে ঘরে দিনরাত নব্বইয়ের দশকের হিন্দি গান বাজে। দোকানের সাইনবোর্ড, সিএনজির গায়ে বা এলিট ফোর্সের হেলমেটে সর্বত্রই ভুল বানানের ছড়াছড়ি।

পরিশেষে বলতে চাই, এ ছবিতে যে বাংলাদেশ কিংবা ঢাকাকে দেখানো হয়েছে সে দেশ কিংবা ঢাকা শহর আমাদের নয়। এ ধরনের মিথ্যা ও কুৎসিত চিত্রায়ণ বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশের সরকার ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ে আস্থার ঘাটতি তৈরি করবে নিশ্চিত। এ মুভি দেখার পর আমাদের প্রবাসী বাঙালিরা কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রে নিয়োজিত আমাদের শান্তিরক্ষীরা যখন তাদের সহকর্মীদের বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে, এ আমাদের বাংলাদেশ নয়, তখন তাদের পাশে বসে থাকা বিভিন্ন দেশের মানুষ বিদ্রƒপের হাসি আড়াল করবে। আশির দশকে একটা কথা প্রচলিত ছিল, Perception is stronger than fact. একবিংশ শতাব্দীতে এ কথাটিকে আরও জোরালো করে মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক লি এটোয়াটার বলেছিলেন, Perception is reality. তাই ব্যবসায়িক স্বার্থ কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যেই হোক- হলিউড পরিচালক স্যাম হারগ্রেভ এক্সট্রাকশন মুভিটিতে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ বা ঢাকার যে Perception বা ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন সেটাকেই লাখো কোটি অবাঙালি দর্শক তাদের মনের ভিতর সত্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকলে সত্যিই বাংলাদেশের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। প্রিয় পরিচালক! অগভীর জ্ঞান আর জোড়াতালি প্রেক্ষাপটের ওপর নির্মিত আপনার প্রথম মুভি দিয়ে সরল দর্শকদের ঠকিয়ে আপনি উপার্জন না হয় করলেনই, কিন্তু আমাদের ভাবমূর্তি ফেরত দেবে কে?

সর্বশেষ খবর