বুধবার, ৬ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

জীবনযাপনে সীমালঙ্ঘন ও তার পরিণতি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

জীবনযাপনে সীমালঙ্ঘন ও তার পরিণতি

করোনাকালে ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী যে তছনছ চলছে তাতে সবার কাছে এটা প্রতিভাত হচ্ছে যে, কারও কাছে কোনো সম্পদ বা প্রতিপত্তি স্থায়ী নয়। মাহে রমজানে সিয়াম সাধনায় পার্থিব জীবনযাপনের নিত্যতা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও একই মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। ধন-স¤পদের প্রাচুর্যে ভরা আরাম-আয়েশ, উল্লাস-ঐশ্বর্যময় জীবনযাপনে চিরন্তন শান্তি নেই। ভোগে নয় ত্যাগেই মুক্তি। এই উপলব্ধিরও বিকল্প নেই যে, কৃচ্ছ্রতা সাধনের মধ্যে রয়েছে স্থায়ী পরিতৃপ্তি ও কল্যাণের নিশ্চয়তা। কোরআনুল করিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন  “তোমাদের নিকট যা আছে তা নিঃশেষ হবে এবং আল্লাহর নিকট যা আছে তা স্থায়ী। যারা ধৈর্য ধারণ করে আমি নিশ্চয়ই তাদেরকে তারা যা করে তা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।” (১৬ সংখ্যক সুরা আন নাহল। আয়াত ৯৬-৯৭)।

‘তোমাদের নিকট যা আছে’ তাফসিরকারকগণের মতে, এর মধ্যে পার্থিব ধন-সম্পদ অন্তর্ভুক্ত তো আছেই, এ ছাড়া দুনিয়াতে মানুষ আনন্দ-বিষাদ, সুখ-দুঃখ, সুস্থতা-অসুস্থতা, লাভ-লোকসান, বন্ধু-শত্র“তা ইত্যাদি যেসব অবস্থার সম্মুখীন হয়, সবই এর মধ্যে পড়ে। বাস্তবিক বিচারে এগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এসব অবস্থা ও ব্যাপারের প্রতিক্রিয়া, যার কারণে শেষ বিচারের দিনে সওয়াব কিংবা শাস্তি সাব্যস্ত হবে তার হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। সুতরাং পার্থিব ধন-সম্পদ এবং এসব ধ্বংসশীল ও অস্থায়ী অবস্থা ও কাজ-কারবারে মগ্ন থাকা, এসব অর্জনে অবৈধ পথ পন্থা অবলম্বন করা, সীমা লঙ্ঘন করা এবং জীবন ও জীবনের কর্মক্ষমতা এ ব্যাপারে নিয়োজিত করা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। যে সম্পদ ও বিষয়াবলি ক্ষণস্থায়ী এবং যার স্থায়িত্বের ও ভূমিকার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই বা থাকবে না তা অর্জনে অবৈধ পন্থা অবলম্বনের দ্বারা পাপাচারে লিপ্ত হওয়া, সীমা লঙ্ঘন করা এবং ফলশ্রুতিতে ইহ ও পরকালে শাস্তি ভোগের সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে যুক্তি নেই। জাগতিক সুনাম কিংবা সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে অনেকে অন্ধভাবে সম্পদ অর্জনে আত্মহারা হয়ে যায়। ক্ষণস্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা বিধানে নিজের সক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা থাকায় এবং নিজের অবর্তমানে সন্তান-সন্ততি কীভাবে এই সহায় সম্পত্তি ভোগ করবে সে ব্যাপারেও নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অন্ধভাবে সম্পদ অর্জনে নিজের আত্মাকে কলুষিত করার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বনের তাগিদ রয়েছে এ আয়াতে। পরবর্তী আয়াতে আনন্দময় জীবন বা ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’ বলতে দুনিয়ার পবিত্র ও আনন্দময় জীবন বোঝানো হয়েছে। এই পবিত্র ও আনন্দময় জীবনের অর্থ আবার এই নয় যে, সে জীবনে মুমিন ব্যক্তি কখনো অনাহার, উপবাস ও অসুখ-বিসুখের বিপদ-আপদের সম্মুখীন হবে না। ব্যাখ্যা এই যে, মুমিন ব্যক্তি কোনো সময় আর্থিক অভাব-অনটন কিংবা কষ্টের সম্মুখীন হলেও দুটি বিষয় তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেয় না (১) অল্প তুষ্টি এবং অনাড়ম্বর জীবনযাপনের অভ্যাস, যা দারিদ্র্যের মাঝেও কেটে যায় (২) এটি এই বিশ্বাসে যে, এই অভাব-অনটন ও অসুস্থতা, দুর্বিপাক ও দুর্ঘটনার বিষয়গুলো ক্ষণস্থায়ী এবং এর বিনিময়ে পরকালে সুমহান ও চিরস্থায়ী নিয়ামত পাওয়া যাবে। দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন কাফের ও পাপাচারীর অবস্থা এর বিপরীত। সে অভাব-অনটন, অসুস্থতা ও বিপদাপদের সম্মুখীন হলে তার জন্য সান্ত্বনার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সে নিরতিশয় উদ্বিগ্ন হয়ে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রায়শ আত্মহত্যা করে। পক্ষান্তরে সে যদি সচ্ছল জীবনের অধিকারী হয় তবে লোভের আতিশয্য তাকে শান্তিতেও থাকতে দেয় না। সে কোটিপতি হয়ে গেলে অর্বপতি হওয়ার চিন্তায় জীবনকে বিড়ম্বনাময় করে তোলে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এই উপলব্ধিকে জাগ্রত করে। [লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান]

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর