শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৭ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

মাহে রমজানে সংযম ও ধৈর্য

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মাহে রমজানে সংযম ও ধৈর্য

সংযম ও ধৈর্য সিয়াম সাধনার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত। রোজা পালনের দ্বারা প্রবৃত্তির ওপর আকলের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। এর দ্বারা মানুষের পাশবিক শক্তি অবদমিত হয় এবং রুহানি শক্তি বৃদ্ধি পায়। কেননা ক্ষুধা ও পিপাসার কারণে মানুষের জৈবিক ও পাশবিক ইচ্ছা হ্রাস পায়। এতে মন্যুষত্ব জাগ্রত হয়। যে কোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য অবলম্বন, সহনশীলতা প্রকাশ, পারস্পরিক সম্ভ্রমবোধ ও সৌজন্য প্রদর্শন, সর্বোপরি সকল কার্যকলাপে মুক্তবুদ্ধি বিবেচনাপ্রসূত মাত্রা ও মূল্যবোধের অনুসরণ ব্যক্তি তথা সমাজ জীবনের অনিবার্য অবলম্বন হওয়া আবশ্যক। চলনে-বলনে, চিন্তা-চেতনায়, আগ্রহ-আকাক্সক্ষায়, আবেগ-উৎকণ্ঠায়, আনন্দ-সর্বনাশে সর্বত্র একটা মধ্যপন্থা অবলম্বনের ওপর আল কোরআনে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এটা অনস্বীকার্য যে, যে কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ভিন্নতর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। যেমন মাত্রা অতিক্রম করলেই সাহস হঠকারিতায়, আত্মোৎসর্গ আত্মহত্যায়, প্রতিযোগিতা হিংসায় পরিণত হতে পারে। অবস্থাবিশেষে সমালোচনা পরচর্চায়, প্রশংসা চাটুবাদে, তেজ ক্রোধে, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতায় এবং অতি ধর্মপ্রীতি ধর্মান্ধতার স্তরে নেমে আসতে পারে। পরিমিত বোধের ব্যাপারে আল কোরআনে বহুবার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। লোকমান হাকিম তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিচ্ছেন, ‘অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না। কারণ আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। তুমি পদক্ষেপ করিও সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করিও; স্বরের মধ্যে গর্দভের স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (৩১ সূরা লুকমান, আয়াত : ৮-১৯)।

ক্যানভাসে রং ও তুলির সুষম সমন্বয়ে শিল্পের সার্থকতা ফুটে ওঠে। পারিপার্শ্বিক সবকিছুর পরিমিত অবস্থান ও শৃঙ্খলামন্ডিত উপস্থাপনার মধ্যেই সৌন্দর্যের যথার্থ বিকাশ। নিয়মনিষ্ঠা ও সহনশীলতা যে কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতিতে মেজাজ-মর্জি, আস্থা ও অবস্থান এমনকি প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষেত্রেও দান করে এক অনুপম মর্যাদা। বিশ্বাসে ও ব্যবহারে, জীবনযাপন ও মানবিকতায় মাত্রা অতিক্রমকারী বনি ইসরাইল, লুত ও ছামুদ জাতির অশুভ পরিণতির কথা কোরআনে প্রায়শই উদাহরণস্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। সংযম ও সহনশীল হওয়ার উপদেশ বারবার দেওয়ার পর কোরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে- মাত্রা অতিক্রমকারীর অশুভ পরিণতি এবং বলা হয়েছে আল্লাহতাকে ভালোবাসেন না। (৫ম সূরা মায়িদা-৮৭ আয়াত। ২য় সূরা বাকারা-১৯০ আয়াত)। কোরআনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে- ‘আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনায় ও কার্যকলাপে মাত্রা অতিক্রমকারীদের স্বাভাবিক সুচিন্তাবোধ ও বুদ্ধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।’ বলা হয়েছে, ‘মানুষকে যখন দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করে তখন সে শুয়ে বসে অথবা দাঁড়িয়ে আমাকে ডেকে থাকে; অতঃপর আমি যখন তার দুঃখ-দৈন্য দূরীভূত করি, সে এমন পথ অবলম্বন করে, যেন তাকে যে দুঃখ-দৈন্য ¯পর্শ করেছিল তার জন্য সে আমাকে ডাকেইনি। যারা সীমা লঙ্ঘন করে তাদের কর্ম তাদের কাছে এভাবে শোভন প্রতীয়মান হয়। (১০ম সূরা ইউনুস। আয়াত ১২)। ভয়, ক্ষুধা, ধন-মালের, ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নানান দুর্ঘটনা উ™ভূত বলে প্রতীয়মান হয়। সন্দেহ নেই এতে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে- ব্যক্তি তথা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যে কোনো সময় নানান দুর্ভোগ ও দুর্বিপাক আপতিত হতে পারে। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্লাবন ইত্যাদি যখন গোটা সমাজের ওপর দুর্দশা ও বিপদ নিয়ে আসে তখন গোটা সমাজ তথা সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তা ধৈর্যের সঙ্গেই মোকাবিলা করা উচিত। ধীরস্থিরভাবে যে কোনো বিপদ অতিক্রম করার লক্ষ্যে সার্বিক প্রচেষ্টা চালাতে হয়। এ পরিস্থিতিতে ব্যক্তি ও সমষ্টিকে ধৈর্য ও সালাতের শক্তি ও সাহায্য নিতে হয়, একই সঙ্গে ইমানের ওপর দৃঢ় আস্থা রেখে ধৈর্য ধারণে অবিচল থাকার জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হয়। ১০৩ সংখ্যক সূরা ‘আসর’ -এ স্পষ্টতই উল্লেখ করা হয়েছে- ‘মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (আয়াত ২-৩)। বিপদে অন্যের সহযোগিতার বিষয়টিও এখানে বিশেষ তাৎপর্যবহ। বিপদগ্রস্ত সমাজের সবাই ধৈর্য ধারণেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকবে না, পরস্পর সহযোগিতা অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির বৈষয়িক সাহায্যে এগিয়ে আসাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি পরিস্থিতিতে জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পারস্পরিক সাহায্য আদান-প্রদানে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে উক্ত প্রয়াসে উপযোগী নেতৃত্ব দান ও সফল কর্ম সম্পাদনে সহায়তা করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ ভূমিকা পালনে কোনো বিপর্যয়ই কোনো সমাজকে কাঁবু করতে পারে না। 

ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে বিপদ মোকাবিলার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর অপার সন্তুষ্টি ও সমর্থন। সূরা বাকারার ১৭৭ আয়াতের এই অংশটি এখানে প্রণিধানযোগ্য- ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোনো পুণ্য নেই, কিন্তু পুণ্য আছে... অর্থ সংকটে, দুঃখ ক্লেশে ও সংগ্রামে সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে।’

[লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর