রবিবার, ১০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার বড় ধাক্কা রেমিট্যান্সে

মধ্যপ্রাচ্যে বিপাকে শ্রমজীবীরা, চাকরি নেই, লকডাউনে জীবন-জীবিকা বেহাল একই চিত্র মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরে, অর্থ আসছে না উন্নত বিশ্ব থেকেও

মানিক মুনতাসির ও আলী রিয়াজ

করোনার বড় ধাক্কা রেমিট্যান্সে

লকডাউনের কারণে বিদেশে অনেক বাংলাদেশি শ্রমজীবীই এখন অলস সময় পার করেন ছবি : সংগ্রহ

বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতির অন্যতম বড় নিয়ামক রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে কভিড-১৯ মহামারীতে। গত বছরের শেষের দিকে রাজস্ব আদায়, আমদানি-রপ্তানিসহ অর্থনীতির বড় সূচকগুলো নাজুক অবস্থায় চলে গেলেও চাঙ্গা ছিল একমাত্র রেমিট্যান্স প্রবাহ। কিন্তু ডিসেম্বরের শেষ দিকে কভিড-১৯ আতঙ্ক শুরু হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ে। আর কভিড-১৯ মহামারী রূপ নিলে জীবন বাঁচাতে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরার ঢল নামে। সে সময় দুই লাখের বেশি প্রবাসী দেশে ফিরে আসেন। আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) আশঙ্কা করছে, অন্তত ১০ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক কর্ম হারাবেন করোনার প্রভাবে। একই সঙ্গে ডিসেম্বরের পর থেকে করোনাভাইরাস আতঙ্কে দেশে দেশে লকডাউন ঘোষণা করায় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়েন। এখনো তারা কর্মহীনই রয়েছেন। বিদেশের মাটিতে কর্মহীন হয়ে পড়ায় সেখানে নিজেদের জীবন চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন প্রবাসীরা। ফলে তারা আর আগের মতো রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না। এ ছাড়া কভিড-১৯-এর প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে আরও লক্ষাধিক প্রবাসী কর্ম হারাতে পারেন বলে তারা শঙ্কায় রয়েছেন, এমনটাই জানিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯-এর প্রভাবে অন্তত ১০ লাখ প্রবাসী কর্মহীন হয়ে পড়বেন, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে বলে মনে করে এডিবি। অবশ্য এমন পরিস্থিতি শুধুই যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হবে তা নয়। বরং বিশ্বের বহু দেশের অবস্থাই ঠিক এ রকমই হবে বলে সংস্থাটির আশঙ্কা। এ জন্য কভিড-১৯-পরবর্তী বিদেশে শ্রমবাজার চাঙ্গা করতে নতুন নতুন বাজার খোঁজার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে এখন থেকে শতভাগ দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে মত দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবাসী আয়ে ২০ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। অন্য খাতের মতো করোনার ধাক্কা লেগেছে এখানেও। ফলে বড় ধরনের পতন হয়েছে সূচকটিতে। এপ্রিলে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা মাত্র ১০৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। আগের বছরের একই মাসের তুলনায় যা ৩৫ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম। শুধু তা-ই নয়, রেমিট্যান্সের এই প্রবৃদ্ধি গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কভিড-১৯-এর আতঙ্কে সারা বিশ্বেই প্রায় সব ধরনের শিল্প-কারখানা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হোটেল, মোটেল ও পর্যটন সম্পর্কিত সব ধরনের সেবা ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রবাসীরা বেকার হয়ে গেছেন। এতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কুয়েত, দুবাই, ওমান, বাহরাইনসহ এ অঞ্চলের প্রায় সব দেশের বাংলাদেশি প্রবাসীরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সেই সঙ্গে করোনাভাইরাসের কারণে ইউরোপের দেশগুলোতেও কর্মসংস্থান হারিয়েছেন অনেক বাংলাদেশি। এসব দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ফিরেও এসেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বিদেশ থেকে পাঠানো প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ছিল ঊর্ধ্বমুখী। চলতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৬৩ কোটি মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। চলতি বছরের শুরুতে জুলাইয়ে ছিল ১৬০ কোটি ডলার, আগস্টে ১৪৫ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ১৪৮ কোটি ডলার, নভেম্বরে ১৫৬ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রথম সাত মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ফেব্রুয়ারি মাসে কমতে শুরু করে রেমিট্যান্স পাঠানো। ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স আসে ১৪৫ কোটি ডলার, মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ১১৫ কোটি মার্কিন ডলারে, এপ্রিলে নেমে আসে ১০০ কোটি ডলারের নিচে। তবে রেমিট্যান্স কমলেও কভিড-১৯ মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সহায়তা, অনুদান ও ঋণ ছাড়ের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এর রেশ দীর্ঘদিন থাকবে। একটা সংকট হলো অনেক প্রবাসী ইতিমধ্যে কাজ হারিয়েছেন। আরও অনেকেই কাজ হারাবেন। একই সঙ্গে নতুন করে শ্রমিক পাঠানোটাও এখন আগের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের হবে বলে মনে করেন তিনি। অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেছেন, ‘আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অংশ থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। করোনাভাইরাসের কারণে তেলের দাম কমেছে ব্যাপক হারে। ইতিমধ্যে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক দেশে চলে এসেছে। আগে যারা এসেছিলেন তাদের আর ফেরত নেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ মারাত্মক হুমকিতে পড়বে এতে সন্দেহ নেই। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জোর করে শ্রমিক পাঠাবে। বিশেষ করে সৌদি আরব ও বাহরাইন শ্রমিকদের সেখানে স্থানীয়করণ করছে। বিদেশি শ্রমিক বাদ দিয়ে স্থানীয় শ্রমিক নিয়োগ দেবে তারা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী কাজ হারাতে পারে। এখন এ সংখ্যাটি আরও বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সামনে রেমিট্যান্স প্রবাহে আরও খারাপ সময় আসছে আমাদের জন্য। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশসহ শ্রীলঙ্কা, ভারত, ফিলিপাইনের শ্রমিকরা বেশি কাজ করেন। ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ভারত লবিং করছে শ্রমিকদের জোর করে যেন পাঠিয়ে না দেয়। বাংলাদেশকেও দ্রুত সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে লবিং করতে হবে। এ ছাড়া কলম্বো প্রসেসের আওতায় পদক্ষেপ নিতে হবে।’ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এরপর যারা দেশে আসবেন বা আসতে বাধ্য হবেন, তাদের করোনা ব্যবস্থাপনার আওতায় কর্মসংস্থানের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের কীভাবে কাজ দেওয়া যায় সেই পরিকল্পনা নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর