রবিবার, ১০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে মৃত্যু অতিরিক্ত সচিবের

নিজস্ব প্রতিবেদক

একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে মৃত্যু অতিরিক্ত সচিবের

একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে কিডনি জটিলতায় অবশেষে মারা গেলেন অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার। রাজধানীর ল্যাবএইড, স্কয়ার, ইউনাইটেড, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রিজেন্ট হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্নসহ রাজধানীর আরও কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও বাবার চিকিৎসা করাতে পারেননি মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ। এ নিয়ে নিজের আক্ষেপের কথাও বলেছেন গণমাধ্যমে। অন্য কোনো হাসপাতাল না পেয়ে শেষে বৃহস্পতিবার করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট কুর্মিটোলা  জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল এই সরকারি কর্মকর্তাকে। গতকাল বেলা ১২টার দিকে গৌতম আইচের মৃত্যু হয় বলে তার  মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ জানান।

করোনাভাইরাস সংকটের এই সময়ে কিডনির জটিলতায় অসুস্থ অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারকে নিয়ে একের পর এক হাসপাতাল ঘুরতে হলো তার পরিবারকে। সুস্মিতা গণমাধ্যমকে বলেন, করোনার কোনো উপসর্গ না থাকলেও অন্য কোনো উপায় না  পেয়ে অনেক কষ্টে বাবাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করাই। বাবার আইসিইউ সাপোর্টটা খুব দরকার ছিল, কিন্তু তা পাওয়া যায়নি। বাবার চিকিৎসাই হলো না, তিনি মারা গেলেন। আমি ডাক্তার হয়েও কিছু করতে পারলাম না।

যে ৩৩৩ হটলাইন নম্বর থেকে সরকার স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে, সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. সুস্মিতা। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও তার বাবা করোনা আক্রান্ত কিনা, তা জানার চেষ্টাও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করেনি। তবে ডা. সুস্মিতা বলেন, ‘বাবার কিডনির সমস্যা ছিল, নিয়মিত ডায়ালাইসিস পেতেন। ডায়ালাইসিসের সময় প্রায়ই হঠাৎ করে প্রেসার বেড়ে যেত, শ্বাসকষ্ট হতো, লাংসে পানি চলে আসত। আইসিইউ সাপোর্ট হলে ঠিকও হয়ে যেত।’

গত বৃহস্পতিবার ল্যাবএইড হাসপাতালে অতিরিক্ত সচিব গৌতমের ডায়ালাইসিসের সময় প্রেসার বাড়ার পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ল্যাবএইডের ইমারজেন্সি থেকে চিকিৎসক মেয়ে সুস্মিতাকে ফোন করা হয়। সুস্মিতা বলেন, আমি বাবাকে ল্যাবএইডে ভর্তি করাতে বলি। তখন তারা বলে, তাদের কনসালট্যান্ট নেই, ভর্তি রাখতে পারবে না। তারা জানায়, ল্যাবএইডে তারা আইসিইউ সাপোর্ট দিতে পারবে না। তাই প্রেসার কমানোর ওষুধ দিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে বলে। ল্যাবএইডে তিনি নিয়মিত যে ডাক্তারকে দেখান তিনিও সেদিন ছুটিতে ছিলেন।

ডা. সুস্মিতা জানান, আমার কাছে মনে হয়েছে বাসায় আনা ঠিক হবে না, এই মুহূর্তে অক্সিজেন দরকার। বিকাল ৪টায় ডায়ালাইসিস শেষ হয়, আমরা বাবাকে নিয়ে বিকাল ৫টার দিকে ইউনাইটেড হাসপাতালে যাই। তাদের কথা, শ্বাসকষ্ট যেহেতু হচ্ছে, করোনা কিনা? তার কোনো জ্বর ছিল না। আমি নিজে ডাক্তার পরিচয় নিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে বললাম। তখন তারা বলল, কোনো রেফারেন্স ছাড়া তারা ভর্তি নিতে পারবে না। সেখানে আমরা করোনা টেস্ট করাতে চাইলে তারা আইইডিসিআরের কথা বলে। তখন তো টেস্ট করানো বন্ধ করে দিয়েছে!

পরে গৌতমকে নিয়ে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান তার মেয়ে। সুস্মিতা বলেন, তারাও টেস্ট করানোর কথা বলে স্কয়ারে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেখান থেকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে আসি, কিন্তু তারা পেশেন্টকে দেখেইনি,  চেকও করেনি। তারা বলে, ভর্তি নিতে পারবে না। যেহেতু আমি এই হাসপাতালে কাজ করেছি, আমি অতিরিক্ত পরিচালকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি চেস্ট এক্সরে করিয়ে আনতে বলেন। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিল বাবা স্ট্রোক করেছেন। কারণ, তার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর তিনি করোনা টেস্ট করানোর কথা বলেন। ওখানে আইসিইউ সাপোর্ট দিতে পারবে না বলে জানানোয় স্কয়ারে নিয়ে যাই।

ডা. সুস্মিতা জানান, স্কয়ার হাসপাতাল জানায়, তাদের পক্ষে ভর্তি  নেওয়া সম্ভব নয়, তারাও টেস্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। পরে সেখান  থেকে ঢাকা মেডিকেলে যাই। তারা বলে, এই পেশেন্টকে কার্ডিয়াক সাপোর্ট দেওয়া দরকার, কিডনির পেশেন্ট যেহেতু। আমাদের এই সাপোর্ট শুরু হয়নি, আমরা পারব না। সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দীর কার্ডিয়াকে যাই। তারা রাখতে পারবে না বলে জানায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা বলি, তারাও বলে, এই মুহূর্তে ভর্তি নেওয়া সম্ভব না। আমি মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতালেও গিয়েছি। আমাদের আশপাশে এমন কোনো হাসপাতাল নেই যেখানে ভর্তি করানোর চেষ্টা করিনি। পরে সাড়ে ৯টার পর যখন আর কিছু করার ছিল না তখন আমরা বাসায় এসে বসে থাকি। কারণ আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। 

সুস্মিতা জানান, আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে একজন ডাক্তার হিসেবে আমি জানতাম বাবার কী হয়েছে, কিন্তু আমি কোথাও তাকে আইসিইউ সাপোর্টে নিতে পারলাম না। তার একটা আইসিইউ সাপোর্ট হলেই হতো, আমি তার হিস্ট্রিটা খুব ভালোমতোই জানি।

সব হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি করাতে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে নিয়ে যখন বাসায় বসে আছেন, তখন তাদের এক আত্মীয় অনেক  চেষ্টার পর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একটা ‘সিট ম্যানেজ’ হওয়ার খবর জানান। সুস্মিতা বলেন, রাত ১০টার দিকে আমাদের একজন রিলেটিভ একটা রেফারেন্সে কুর্মিটোলায় একটা জেনারেল  বেডের অ্যারেঞ্জ করেন। বাবার অক্সিজেনের খুব বেশি দরকার হওয়ায় তার করোনার কোনো উপসর্গ না থাকলেও তাকে ওই হাসপাতালে নিয়ে যাই। বাবাকে আলাদা কেবিনে রাখা হয়। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে বাবার অক্সিজেন ফল করতে শুরু করল। যে বেডে তাকে রাখা হয়েছিল সেখানে কোনো সরকারি ডাক্তার যায়নি। তারা আমাকে ওষুধ বুঝিয়ে দেয়, আমিই ওষুধ খাওয়াচ্ছি, আমার ভাই অক্সিজেন দিচ্ছে।

সুস্মিতা বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, শুক্রবার সকালে করোনা পরীক্ষা করাবেন। আমরাও সেটাই চাইছিলাম। করোনার রিপোর্টটা  পেলে সেই অনুযায়ী আমরা অন্য ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, প্রয়োজনে ভালো কোনো বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতাম। কিন্তু শুক্রবার সারা দিন তারা টেস্টই করায়নি। বাবা মারা যাওয়ার পর তারা বলছে, আগেই নমুনা নেওয়া দরকার ছিল। আমরা বললাম, এখন নিয়ে নেন। আমরা এখনো করাতে চাই। আমি ডাক্তার হিসেবে মনে করি, বাবার করোনার কোনো উপসর্গ ছিল না। ডায়ালাইসিসের সময় তার আগেও এমন হয়েছে। এ অবস্থায় হাসপাতালগুলো চাইলেই তাকে ভর্তি নিতে পারত। করোনা সন্দেহ হলে প্রয়োজনে আইসোলেশনে রাখতে পারত, কিন্তু কেউ সেটা করেনি।

ডা. সুস্মিতা আরও বলেন, বাবার প্রোপার ট্রিটমেন্ট হয়নি। আমরা ভয় পাচ্ছিলাম স্ট্রোক করেছে। একটা পা নাড়াতে পারছিলেন না, কথাও বলতে পারছিলেন না। ল্যাবএইডের ইমারজেন্সি থেকেও বলেছে, উনি মনে হয় স্ট্রোক করেছেন। আমি আমার বাবাকে নিয়ে সাফার করছি। বিশেষ করে নরমাল পেশেন্ট যারা, করোনা না, আমার বাবার মতো কিডনি পেশেন্ট, তারা কী করবেন, তাদের জন্য কী করছেন? কারণ, আমি যে হাসপাতালেই গিয়েছি সবাই বলেছে,  টেস্ট (রিপোর্ট) আনেন। আমি টেস্টটা কোথায় করাব?

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর