সোমবার, ১১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

কবে খুলবে সচিবালয়

সরকারের রাজস্ব আসা খাতগুলোসহ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলার পক্ষে বিশেষজ্ঞরা

নিজামুল হক বিপুল

গত মাসের শেষ সপ্তাহে সরকার সীমিত আকারে অফিস-আদালত খুলে দিলেও এখন পর্যন্ত খোলেনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দফতর। সচিবালয় কবে খুলবে কেউ জানে না। যেসব খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আসে সেই খাতগুলোর কার্যক্রম বলতে গেলে এখন পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। বন্দরগুলো এখনো সচল হয়নি। ভূমি রাজস্ব আদায়ও বন্ধ রয়েছে। কিছু দফতর খুললেও সেগুলোতে তেমন কাজকর্ম হচ্ছে না। উন্নয়ন কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে ঠিকাদারদের কাছ থেকে বিপুল রাজস্ব এলেও সেই খাতও এখন বন্ধ। এ অবস্থায় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয় পূর্ণাঙ্গভাবে কবে খুলবে, কবেই বা গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলো নিজেদের কাজে সক্রিয় হবে- এ নিয়েই এখন আলোচনা বিভিন্ন মহলে। সরকারের সাবেক আমলা, সংশ্লিষ্টজন ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যেহেতু ঝুঁকি নিয়েছে, সীমিত আকারে অফিস খুলেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা খুলে দিয়েছে, সেহেতু স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়সহ রাজস্ব আয়ের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোও খুলে দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে প্রায় দুই মাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এসব দফতরে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে শিফটিংয়ের মাধ্যমে সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম চালানো এখন জরুরি। দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার ১৫ দিনের মাথায় ২৩ মার্চ সরকার সাধারণ ছুটির ঘোষণা দেয়, যা ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার ছুটির এই পদক্ষেপ নেয়। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে এই ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ১৬ মে পর্যন্ত। সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর প্রথম দিকে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ যেসব দফতর করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কাজে জড়িত, সেগুলো সীমিত আকারে খুব স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে খোলা রাখা হয়। দফায় দফায় ছুটির মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে ২৬ এপ্রিল থেকে সারা দেশে সীমিত আকারে অফিস খুলে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঈদ সামনে রেখে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, শপিং মল খুলে দেওয়া হয়েছে সবই। অথচ বাংলাদেশ সচিবালয় ও সরকারের রাজস্ব আসে এমন সরকারি দফতর এবং সমুদ্র ও স্থলবন্দরগুলো এখন পর্যন্ত পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়নি। ফলে সরকারের রাজস্ব আয় রীতিমতো বন্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু সরকার সবকিছু খুলে দিচ্ছে সেহেতু আর সময় নষ্ট না করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে রাজস্ব আসে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত খুলে দেওয়া দরকার। একই সঙ্গে সচিবালয়ে গুরুত্ব বিবেচনায় প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ও খুলে দেওয়া উচিত।

এ প্রসঙ্গে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের সবচেয়ে বড় রেভিনিউ খাত হচ্ছে আমদানি শুল্ক। বিশেষ করে দেশের সমুদ্র ও স্থলবন্দরগুলো থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে। তিনি বলেন, যেহেতু অনেক অফিস খুলে দেওয়া হয়েছে, শপিং মল, দোকানপাট প্রায় সবকিছুই খুলে দেওয়া হয়েছে, তাই প্রতিটি সমুদ্র ও স্থলবন্দর সচল করে দেওয়া দরকার। তিনি বলেন, সমুদ্র ও স্থলবন্দর খুলে দিলেই কাজ শেষ হয়ে যাবে না। এসব বন্দরে পণ্য খালাস করা, খালাসকৃত পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছানো ও এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই রাজস্ব আয়ের চাকা ঘুরবে। মন্ত্রিপরিষদের সাবেক এই সচিব মনে করেন, অ্যাডভান্স আয়কর যেসব উন্নয়ন কাজ থেকে আসে, সেগুলোও চালু করে দেওয়া দরকার। বিশেষ করে ঠিকাদাররা যেসব উন্নয়ন কাজ করেন, সেগুলোর বিল পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গেই রাজস্ব চলে আসে। তাই এসব উন্নয়ন কাজ দ্রুত চালু করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, সোনারগাঁও, কন্টিনেন্টালের মতো হোটেল, ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাবের মতো যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোও স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেওয়া যায়। কারণ এসব জায়গা থেকে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট আসে। সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ভূমি থেকে খুব বেশি রেভিনিউ সরকার পায় না। তবে ভূমি রেকর্ডের জন্য এই দফতরও খুলে দেওয়া দরকার। বহু মানুষের কাজ আটকে আছে।

সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ পর্যায়ে সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পুরোপুরি খুলে দেওয়া দরকার। তার মতে, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ, খাদ্য, কৃষি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ভূমি, ধর্ম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ই স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেওয়া উচিত। সাবেক এই সচিব বলেন, প্রতিটি মন্ত্রণালয় গত দুই মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সপ্তাহের সাত দিনই ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা উচিত। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তিন ভাগে ভাগ করে তিন শিফটে কাজ চালানো যেতে পারে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এই সময়ে ছুটিও বাতিল করে দিতে হবে। এতে করে কম সময়ের মধ্যে বিগত দিনের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা উচিত।

সাবেক এই সিনিয়র সচিব বলেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুম খোলা থাকা দরকার। কারণ এখন জরুরি হচ্ছে পণ্যবাহী পার্শেল ট্রেন, যেগুলো দেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে নিত্যপণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। ট্রেনগুলো ঠিকমতো চলছে কিনা তা সার্বক্ষণিক মনিটরিং জরুরি।

সাবেক এই সচিব বলেন, এই দুর্যোগের সময়ও কৃষি মন্ত্রণালয় যে সার্ভিস দিয়েছে, সেটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তারা হাওরের শতভাগ ধান কৃষকের ঘরে তুলে দিতে পেরেছে। এটা অভাবনীয়! কৃষি মন্ত্রণালয় যে কাজ করেছে, এখন অন্য মন্ত্রণালয়গুলো তাদের অনুসরণ করতে পারে। শেয়ার মার্কেটও খুলে দেওয়া যেতে পারে। কারণ ঘরে বসে অনলাইনেই কেনাবেচা করা যাবে।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞনিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে। তবে স্বল্প পরিসরে খুলে কয়েক দিন দেখার পর যদি দেখা যায় যে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে না, তখন ধীরে ধীরে পুরোপুরি খুলে দেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। তিনি বলেন, যেসব জরুরি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, প্রয়োজনে সেগুলো খোলা যায়। এ ক্ষেত্রে সবাইকে সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ করতে হবে। এই মাসটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সে কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দেন। তবে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে অসুবিধা নেই। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে না, সামাজিক দূরত্ব মেনেই কাজ করতে হবে।

আর ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে খুবই সীমিত আকারে কাজ শুরু করেছি। আগামী ১৬ মে পর্যন্ত দেখব সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়।’ তিনি বলেন, ‘তবে ঈদের পর আমরা পুরোপুরি সারা দেশে কাজ শুরু করে দেব।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর