সোমবার, ১১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
সমকালের ভাবনা

কোথাও কেউ নেই?

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

কোথাও কেউ নেই?

না, হুমায়ূন আহমেদের সেই বাকের ভাইয়ের নাটক নিয়ে লেখার সময় এটা নয়। আমার জিজ্ঞাস্য জেএমআই  নামক কোম্পানি স্বীকৃতভাবে নকল মুখোশ পাঠিয়ে যে লঙ্কাকান্ডসম  অপরাধ  ঘটাল তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কি কেউ কোথাও নেই? এই লেখাতে আমি আইনের বিষয়গুলো তুলে ধরব যার জন্য প্রথমেই স্বীকৃত তথ্যগুলো  উল্লেখ করছি। জেএমআই কোম্পানি বেশ কয়েকবছর ধরে চুক্তি বলে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছে। করোনা মহামারী শুরু হলে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উক্ত কোম্পানিকে মুখোশসহ চিকিৎসকদের  ব্যবহার্য দ্রব্যাদি সরবরাহের আদেশ প্রদান করলে, কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি প্রখ্যাত N95 এর মোড়কে বেশকিছু  নিম্নমানের  মুখোশ  সরবরাহ করে। মুখোশগুলোর গুণগতমান নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক এবং কর্তৃপক্ষ  বিষয়টি মাননীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীকে জানালে, সাবের হোসেন চৌধুরী বিষয়টি উক্ত মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে  আনয়ন করার পর উক্ত মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিগণ  সরবরাহকারী কোম্পানির নিকট ব্যাখ্যা চাইলে  কোম্পানি অকপটে স্বীকার করে যে N95 মোড়কে দেওয়া হলেও ওই  মুখোশসমূহ N95 নয়।

সোজা কথায় এগুলো যে নকল ছিল তা কোম্পানি স্পষ্টতই মেনে নিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে এবং এগুলো ফেরত নিতে রাজি হয়। এর মধ্যে বহু চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী এগুলো ব্যবহারের কারণে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা আবার পর্যায়ক্রমে তাদের রোগীদের মধ্যেও সংক্রমণ ছড়িয়েছেন। এ ব্যাপারে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় আইনের কথাই বলব। যে মুহূর্তে কোম্পানি নকল মুখোশ এবং আলোচ্য নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ করে সেই মুহূর্তে তারা দন্ডবিধির ৪০৯,৪১৭,৪২০ এবং সম্ভবত বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ ধারাসমূহে বর্ণিত প্রতারণাভিত্তিক অপরাধ সংঘটন করে। তাদের স্বীকারোক্তির অর্থ হলো এসব অপরাধ প্রমাণের জন্য, কোনো সাক্ষী প্রমাণ দরকার নেই। পরবর্তীতে তাদের ক্ষমা প্রার্থনা এবং জিনিসগুলো ফিরিয়ে নেওয়া আইনের দৃষ্টিতে অমূলক, এর ফলে কেবল অপরাধ হয়নি বরং আইনের দৃষ্টিতে তা আরও শক্ত করে প্রমাণিত হয়েছে। এসব অপরাধ দুর্নীতি দমন আইনের তফসিলভুক্ত। যে মুহূর্তে নকল মাস্ক সরবরাহের কথা কোম্পানি স্বীকার করল ঠিক তখনই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল কোম্পানির কর্তাব্যক্তি এবং জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন এবং দন্ডবিধির আইনে ফৌজদারি মামলা করা। কিন্তু রহস্যজনকভাবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্তাব্যক্তি কোম্পানির সুরে, কোম্পানির পক্ষে সাফাই গেয়ে বসলেন, যদিও  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সমালোচনার সুরে বলেছেন, গ্রহণের পূর্বে এগুলো যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিল। উক্ত কর্মকর্তাসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণ কেন সীমানা অতিক্রম করে কোম্পানির পক্ষে সাফাই গাইলেন, তদন্তের মাধ্যমে তা উদ্ঘাটন করতে হবে। কর্মকর্তারা শুধু কোম্পানির সুরে সুর মিলিয়েই ক্ষান্ত হননি তারা মুগদা হাসপাতালের পরিচালককে ওএসডি করলেন, তাঁর অপরাধ তিনি কোম্পানি এবং জড়িত অন্যদের অপরাধের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীদের  কথা বলায় আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা  গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাসমূহে ছাপা হয়েছে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ‘পাপ না ঠেকানো ও পাপ’  বলেছেন  ‘কেবলমাত্র সামনে দাঁড়িয়ে অথবা জলের দিকে তাকিয়ে থাকলে সমুদ্র পেরোনো যায় না’। একই ধরনের কথা বলেছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, বলেছিলেন, অবিচার এবং অন্যায়ের  সঙ্গে আপস নিকৃষ্টতম অপরাধ।

কবিগুরু এবং নেতাজির কথার প্রতিফলন ঘটিয়ে তিনজন স্বনামধন্য সাংবাদিক নঈম নিজাম, পীর হাবিবুর রহমান এবং শ্যামল দত্ত তাদের অসাধারণ লেখনী দ্বারা প্রমাণ করলেন অন্যায় করা এবং অন্যায় সহ্য করা সমভাবে ঘৃণাহ। এই তিনজনের সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল, তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক এবং বঙ্গবন্ধুর কন্যার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের আপসহীন সমর্থক। শ্যামল দত্ত তার লেখনী দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করতে পারে এমন ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গের খুঁটির জোর কোথায়? তার কথায়, এটি রাষ্ট্রের মধ্যে শক্তিশালী রাষ্ট্রের ন্যায়।

ছাত্রলীগের এক সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য বানি ইয়াসমিন হাসি অত্যন্ত সঠিকভাবে খুঁজে পেয়েছেন বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি ছিলাম বলে বিশুদ্ধ স্বার্থত্যাগী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের প্রতি আমার দুর্বলতা স্বাভাবিক, তাই তার এই লেখায় যুক্তি খুঁজে পেয়ে তাকে সাধুবাদ। আমি এটা জেনে আনন্দিত যে, বেশ কয়েকজন সচেতন আইনজীবী এরই মধ্যে কয়েকটি জনস্বার্থ বিষয়ক রিট মামলার খসড়া তৈরি করে রেখেছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন সর্বাধিক জনস্বার্থ মামলার কৃতিত্বের দাবিদার অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ, সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইয়াদিয়া জামান। আরও অনেকে আমার পরামর্শ নিয়েছেন। আশা করি সুপ্রিম কোর্ট খুললেই কয়েকটি জনস্বার্থে রিটের মাধ্যমে  সরবরাহকারী কোম্পানি এবং তাদের সঙ্গে  সম্পৃক্তদের ফৌজদারি এবং দুর্নীতি দমন আইনে বিচারের আওতায় আনা যাবে।

পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদের শিখিয়েছেন, ‘সমাজের মঙ্গলের নিমিত্তে যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহাই করণীয়, লোকের ভয়ে কদাচ সংকোচিত হইবার নয়’। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ড. আবদুল কালামের উক্তিও প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, জয়ী তারা যারা কখনো স্থানচ্যুত হয় না। কথাগুলো এজন্য বলছি যে, এরইমধ্যে সত্যের মুখে কুলুপ লাগানোর প্রয়োজনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা, এই ভয় দেখিয়েছেন যে কেউ নকল মুখোশ নিয়ে কথা বললে তাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সৌভাগ্য যে তাদের কথায় কেউ সত্য চাপা দিচ্ছেন। যারা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ভয় দেখিয়ে সত্য এবং দুর্নীতির অপরাধকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের বলব তারা আইনটি মন দিয়ে পড়লে এবং এর অন্তর্নিহিত দিক বোঝার চেষ্টা করলে তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে স্বীকৃত সত্য কথা বলা এই আইনে অপরাধ নয়। নোবেল বিজয়ী জার্মান উপন্যাসিক হারমান হেসে তার সিদ্ধার্থ উপন্যাসে নদীকে উপমা করে যে তত্ত্বসমূহকে প্রাধান্য দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সত্য প্রকাশের প্রত্যয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল তাদের ভ- বলে আখ্যায়িত করেছেন, যারা সত্যকে অস্বীকার করে। সৌভাগ্য হলো এই যে যারা সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টায় লিপ্ত অনেক জ্ঞানীজন তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। আপাত দৃষ্টিতে কেউ কোথাও নেই বলে মনে হলেও কাজী নজরুলের অনুসরণে অনেকেই বলছেন- সত্যের জয় হোক। শুধু ফৌজদারি মামলাই নয় যেসব চিকিৎসক/ স্বাস্থ্যকর্মীসহ অন্য ব্যক্তিগণ নকল মুখোশ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহার করে সংক্রমিত হয়েছেন তাদের জন্য খোলা থাকবে টর্ট আইনে বিপুল ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানি মামলার দরজা। তাদের অনেকেই নিশ্চিতভাবে টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণের মামলা করবেন বলে বিশ্বাস রেখেই শেষ করছি। লেখক :  আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর