বুধবার, ১৩ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা রোধে নতুন জীবাণুমুক্তকরণ চেম্বার বিপজ্জনক

ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ

করোনা রোধে নতুন জীবাণুমুক্তকরণ চেম্বার বিপজ্জনক

বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ যত বাড়ছে ততই  মানুষের মধ্যে এর প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন উদ্ভাবনী কার্যক্রম পরিলক্ষিত হবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে নতুন কিছু উদ্ভাবন করে যেন ক্ষতি না বাড়ে অবশ্যই সে দিকে লক্ষ্য রেখে এগুলো ব্যবহার করতে হবে। যে কোনো নতুন উদ্ভাবনের পর এর কার্যকারিতা পরীক্ষা এবং তার ক্ষতিকারক দিকটা দেখা আবশ্যক। ইদানীং সিলেটে ও চট্টগ্রামের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে  জীবাণুমুক্তকরণ বা ডিসিনফেক্টিং চেম্বার  নামে যা প্রদান করা হয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে এর মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের পিপিই পরেই   চেম্বারের একদিকে ঢুকে ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করে স্বয়ংক্রিয় জীবাণুনাশক স্প্রে ধারণ করে অন্যদিকে বের হয়ে গেলে তারা জীবাণুমুক্ত হবেন এবং পিপিই পরেই নিশ্চিন্তে নিজঘরে ফিরে যেতে পারবেন। সিলেটের প্রদত্ত একটি ফটকের মতো চেম্বারে ঢুকলেই মেশিন থেকে অনেক স্প্রে দিয়ে ৩% হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিটানো হবে। তাতে বলা হচ্ছে, এতে পিপিইতে থাকা এবং আপাদমস্তকের সব করোনাভাইরাসই মারা পড়বে। ব্যাপারটা এখনই তলিয়ে দেখা খুব জরুরি। এতে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কিনা অথবা এটা কোথায় কীভাবে এর উপকারিতা বা অপকারিতার পরীক্ষা করা হয়েছে- তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রথমত করোনাভাইরাস মানুষের নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। তাই লোকারণ্য জায়গাতে মাস্ক পরা অত্যন্ত জরুরি। হাসপাতালে করোনা রোগী দেখার জন্য ওয়ার্ডে বা ক্যাবিনে ঢুকলে মাস্ক, গগলস ও গাউন পরে রোগীকে সেবা দিতে হবে। গাউন পরে রোগীর ক্যাবিন বা ওয়ার্ড থেকে বের হওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। গাউন খুলে দরজার পাশে রাখতে হবে। তাই কাপড়ের গাউন ব্যবহার করলে তা সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে বার বার পরিধান করা  যাবে। আর কাগজের ডিসপজিবল গাউনগুলো একবারের বেশি ব্যবহার করা যাবে না। গাউনটা কাজের শেষে সন্তর্পণে খুলতে হবে যদি ঝাড়া দেওয়া হয় তা থেকে ভাইরাস উড়তে পারে এবং নিজেকে ও কাছের মানুষকে  সংক্রমণ করতে পারে। পিপিই পরে বাড়িতে কেন হাসপাতালেও ঘুরাফেরা সম্পূর্ণ নিষেধ। পর্যাপ্ত পিপিই না থাকার কারণে সমস্ত বিশ্বে মানুষ তার বার বার ব্যবহারের জন্য অনেক চিন্তা ভাবনা করছেন। নাক, মুখ ও চোখের মধ্যদিয়ে করোনার সংক্রমণের জন্য মাস্কগুলো অত্যন্ত জরুরি। সেটা বার বার ব্যবহারের জন্য CDC তিনটি প্রক্রিয়া উল্লেখ করেছে। তার জন্য আলট্রাভায়োলেট লাইট, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বাষ্প আর অতি মাত্রায় গরম বাষ্প ব্যবহার করা। সাধারণত ৩% তরল হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দিয়ে টেবিল চেয়ার, হাতল, বাথরুম ইত্যাদি সম্পূর্ণভাবে ভাইরাসমুক্ত করা যায়। কাপড় বা কাগজের পিপিএ সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। কারণ সেগুলোর মধ্যে ছোট ছোট অনেক ছিদ্র থাকে এবং কাপড়ের ওপর তা কার্যকর হবে না। সেই জন্য কাপড়ের গাউনকে পানির ভিতর সাবান দিয়ে গরম পানিতে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করার কথা CDC Guideline এ বলা হয়েছে। সাবান পানি শুধু ভাইরাসকে ধুয়ে সরিয়ে দেয় না সাবান ভাইরাসকে প্রথমে ধ্বংসও করে। মেডিকেল মাস্ক যেমন N95 মাস্কের জীবাণুনাশের  জন্য ৩০% ( দশ গুণ বেশি) হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এর থেকে বাষ্প ছড়িয়ে   একটি বন্ধ ঘরে ৪০ মিনিটের মতো রাখলে সেটা আবার জীবাণুমুক্ত করা যায়। এবং সে লক্ষ্যে আমেরিকায় এর প্রক্রিয়া মাত্র শুরু হচ্ছে। সেই বাষ্প অনেকক্ষণ সংস্পর্শে থাকলে তা  মাস্কের ভিতরের ছিদ্রগুলোয় ঢুকতে পারবে। তাই ৩% হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড শুধু ছিটিয়ে আপাদমস্তক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জীবাণুনাশক করার এই নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে স্বাস্থ্যকর্মী এবং তাদের সংস্পর্শে আসা মানুষকে ভয়ানক বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়ার শামিল হবে। ডিসইনফেক্টিং চেম্বারে উপকারী এই মিথ্যা আশ্বাস হবে মারাত্মক ক্ষতিকর। এই পদ্ধতি যদি কার্যকর হয় তবে এর বৈজ্ঞানিক উপায়ে এর কার্যকারিতা এবং এর থেকে ক্ষতিকারক দিকটি অবশ্যই আগে দেখে নিতে হতে হবে। এই দুর্যোগে আমরা চাইব নতুন উদ্ভাবকের মধ্য দিয়ে মানুষের উন্নত সেবা প্রদান করা    তবে তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। যেমন করে বাংলাদেশে কিছু ভেন্টিলেটর, কিছু ডায়াগনস্টিক কিট ইত্যাদি প্রাথমিক  পর্যায়ে পরীক্ষিত হচ্ছে। আমি আশা করব এর উদ্ভাবকরা অনতিবিলম্বে এর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে সরকারের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে এই  পদ্ধতিটা স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষার জন্য প্রদান করবেন। নইলে এই অতি উৎসাহী প্রচেষ্টা হিতে বিপরীত হবে।

লেখক : অধ্যাপক মেডিসিন অ্যান্ড নেফ্রোলজি, টেম্পলে বিশ্ববিদ্যালয়, ফিলডফেলফিয়া; প্রফেসর ইমিরিটাস- ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।

 

 

সর্বশেষ খবর