বৃহস্পতিবার, ১৪ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
করোনাকালীন অর্থনীতির সংকট

চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধই সম্ভাবনা বাংলাদেশের

মানিক মুনতাসির

চীন ও আমেরিকার মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধকেই বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আশীর্বাদ বলে মনে করা হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে চলমান বাণিজ্যবিরোধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কভিড-১৯-এর প্রভাব। চীন থেকে যেসব দেশ বিনিয়োগ প্রত্যাহার করার কথা ভাবছে তাদের সেই বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সরকার ও ব্যবসায়ী নেতারা। এটিকে কাজে লাগাতে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিশ্বব্যাপী মহামারী রূপ নেওয়া কভিড-১৯-এর প্রভাবে বৈশি^ক অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির প্রতিটি খাতই ধুঁকছে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে ট্রিলিয়ন ডলারের বেইল-আউট প্যাকেজ হাতে নিয়েছে। পাশের দেশ ভারতও একই পথে হাঁটছে। বাংলাদেশ সরকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এদিকে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া কভিড-১৯-এর প্রভাব প্রতিনিয়তই প্রকট হচ্ছে। এ ছাড়া এ ভাইরাস চীনের ল্যাব থেকে বেরিয়ে পড়েছে এমন অভিযোগও রয়েছে। যদিও চীন বিষয়টিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। এ বিতর্কের মধ্যেই চীন থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, রাশিয়া, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশ। সেসব দেশের বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করে সরকার। কেননা এসব দেশ চীন থেকে সস্তা শ্রমের বিনিময়ে যেসব পণ্য উৎপাদন ও বিপুল পরিমাণ লাভ করত, এমন সস্তা শ্রম এ মুহূর্তে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও নেই। এ ছাড়া পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ, এমনকি ভারতের তুলনায়ও বাংলাদেশে কভিড-১৯ পরিস্থিতি কিছুটা ভালো। ফলে ওইসব দেশকে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে পারলে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করতে পারবে বলে মনে করে সরকার। এজন্য এমন সংকটকালে এটিকে বাংলাদেশের জন্য বিরাট এক সম্ভাবনা বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এফবিসিসিআইকে উদ্যোগ নিতে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। গতকাল তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যেসব দেশ চীন থেকে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার কথা ভাবছে তাদের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমাদের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা যোগাযোগ শুরু করেছেন। আশা করা যায় আমরা এখানে একটা ভালো ফল পাব।’ তিনি বলেন, ‘জাপান ইতিমধ্যে তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়ার প্রাথমিক কাজও শুরু করেছে। জাপানসহ অন্যান্য দেশের যেসব কোম্পানির চীনে বিনিয়োগ রয়েছে, আমরা সেসব কোম্পাানির একটা তালিকাও করেছি, যেটি আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। তারা সেটি এফবিসিসিআইর কাছে দিয়েছে। এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা এসব কোম্পানির সঙ্গে আমাদের বেসরকারি খাতের একটা সেতুবন্ধ তৈরি করে দিচ্ছি, যেটা সরকার সরাসরি করতে পারত কিন্তু করবে না। কারণ চীনও আমাদের একটা ব্যবসায়িক বন্ধু। তারা আমাদের অনেক উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গেই জড়িত। একইভাবে যারা বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন, তাদের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করতে সরকার প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা করে ঋণ দিচ্ছে সহজ শর্তে। এ ছাড়া দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের প্রশিক্ষিত বা দক্ষ করতে লাইফ চেঞ্জার নামক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। করোনা-পরবর্তী আমাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এসব কর্মসূচি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’ আর এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য অবশ্যই একটা বড় সুযোগ। এর জন্য সরকারও নানাভাবে সহযোগিতা করছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য আমরা কাজ করছি। শুধু চীন থেকে প্রত্যাহার হওয়া দেশগুলোরই নয়, অন্য যে কোনো দেশের বিনিয়োগই বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে আনতে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা কাজ করে যাচ্ছেন।’ এদিকে করোনার কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব শীর্ষক বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা এক প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সাত দফা সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরিই করা হয়েছে কভিড-১৯-এর প্রভাবে সৃষ্ট সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সম্ভাব্য খাদ্য সংকট এড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য চীন থেকে যেসব খাদ্যপণ্য আমদানি করা হয় সেসব পণ্য বিকল্প দেশ ভারত, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, মিসর, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের নানাভাবে প্রণোদনাও দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো একক দেশের ওপর নির্ভর না করে বিকল্প বাজার খুঁজে বের করার সুপারিশ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের কাঁচামালের বেশির ভাগই চীন থেকে আমদানি করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৬৫ শতাংশ চীন থেকে আমদানি করা হয়। এ আমদানি সঠিক সময়ে করতে না পারলে ব্যাপকভাবে লোকসানের মুখে পড়বে তৈরি পোশাক খাত। এটির ক্ষেত্রে বিকল্প আমদানির বাজার খোঁজার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির পরিচালক আবুল কাশেম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য একটা সুখবর। কিন্তু এটিকে যত দ্রুত সম্ভব দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। কোনোভাবেই এটিকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। সরকারের উচিত হবে এর জন্য যা যা করণীয় খুব দ্রুত করা। কেননা এখানে আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভারত, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম সুযোগ নেওয়ার কথা ভাববে। তাদের আগেই আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর হ্যাঁ, কভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বেই বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা অস্থিরতা তৈরি হবে। অনেকেই রিলোকেট করবে। আবার অনেকেই নতুন নতুন বিনিয়োগর স্থান খুঁজবে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমাদের বিদেশি বিনিয়োগের আকর্ষণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর