শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর শোক প্রকাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনা আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গতকাল বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি মারা যান। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগেও ভুগছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, দুই মেয়ে রুচিরা ও শুচিতা, একমাত্র ছেলে আনন্দ জামান এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
আনিসুজ্জামানের ছেলে আনন্দ জামান জানান, সকালে আব্বার করোনা পরীক্ষার নমুনা নেওয়া হয়। বিকালে মৃত্যুর পর আবারও নমুনা নেওয়া হয়। রাত ৯টার দিকে হাসপাতাল থেকে জানানো হয় রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে।
ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। রাষ্ট্রপতি আনিসুজ্জামানের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ২৭ এপ্রিল তাকে রাজধানীর ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হার্ট, কিডনি, ফুসফুস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। এর আগেও গত মাসের প্রথম সপ্তাহে একবার তিনি আরেকটি হাসপাতালে ভর্তি হন। অসুস্থ হলে গত শনিবার জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতাল থেকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি গতকাল মারা যান।
আনিসুজ্জামানের পুরো নাম আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তার পৈতৃক বাড়ি অবিভক্ত ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে। শিক্ষাজীবনের প্রথমভাগ তার কলকাতাতেই কাটে। দেশভাগের সময় তিনি কলকাতার এক স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এরপর আরও অনেকের মতো আনিসুজ্জামানদের পরিবারও চলে আসে এপারে। ঢাকার প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক এবং জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করা আনিসুজ্জামান কৈশোরেই জড়িয়ে পড়েন রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ভাষার দাবিতে মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রথম যে পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল, তা লেখার ভার পড়েছিল তার ওপর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৫৬ সালে স্নাতক এবং পরের বছর স্নাতকোত্তর শেষ করে মাত্র ২২ বছর বয়সে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আনিসুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ১৯৬৫ সালে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তার অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস : ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল’। পরে ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার পদে যোগ দেন। গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আনিসুজ্জামান চলে যান ভারতে। সেখানে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী নানান আন্দোলনে তিনি সব সময় সামনের কাতারে ছিলেন।  ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন আনিসুজ্জামান। সেখানে দেড় যুগ শিক্ষকতা করে ২০০৩ সালে অবসর নেন। দুই বছরের মাথায় আবার তাকে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে বাংলা বিভাগে ফিরিয়ে আনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক।
মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো হিসেবেও কাজ করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই শিক্ষক। দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষকতা, গবেষণা ও মৌলিক সাহিত্য রচনার পাশাপাশি একক ও যৌথভাবে অসংখ্য গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ভাষা ও শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা।
প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে; সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তিনি পান স্বাধীনতা পুরস্কার। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০০৪ সালে ভারত সরকার তাকে সে দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ পদক দিয়ে সম্মানিত করে। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বাধীন জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তাঁর গবেষণা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। আনিসুজ্জামান ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি লিট ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরী ও রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আনিসুজ্জামানকেও জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করে। বরেণ্যে এই শিক্ষাবিদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া, চিফ হুইপ নূর ই আলম চৌধুরীও শোক প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ প্রমুখ। আরও শোক প্রকাশ করেছেন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি)-এর কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর এবং সম্মানী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী খন্দকার মনজুর মোর্শেদ। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এবং আইন কমিশনের সদস্য বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির শোক জানিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর