সোমবার, ১৮ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা সংকটে মেগা প্রকল্প

ব্যয় ও সময় বাড়ার শঙ্কা, কিছুটা অব্যাহত পদ্মা সেতু, শ্রমিকদের কাজে ফেরানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ

নিজামুল হক বিপুল ও মানিক মুনতাসির

করোনা সংকটে মেগা প্রকল্প

মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহেও তুমুল বেগে ছুটে চলছিল দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল লাইন-৬ এর নির্মাণ কাজ। শত শত শ্রমিক দিনে-রাতে কাজ করছিলেন নির্ধারিত সময়ের আগেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্পটি চালু হওয়ার কথা। কিন্তু গত দুই মাসে দৃশ্যমান কোনো কাজই এগোয়নি। করোনাভাইরাসের ছোবলে সবকিছুই বন্ধ। ফলে যথাসময়ে বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে মেট্রোরেলসহ দেশের অন্যান্য মেগা প্রকল্পের কাজ। এ অবস্থায় দেশের চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সময় ও ব্যয় বাড়ার আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে সরকারের পর্যবেক্ষণে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কভিড-১৯ লম্বা সময় ধরে অবস্থান করলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ইতিমধ্যে বলেই দিয়েছে, চলমান কভিড-১৯ পরিস্থিতি বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে সামাল দিতে না পারে তাহলে চলমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থবিরতাসহ নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। দেশে এখন বেশ কিছু মেগা বা বৃহৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- পদ্মা সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্প, দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের প্রায় সবই প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এসব প্রকল্পের কাজ এখন প্রায় বন্ধই রয়েছে। শুধু পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এখনো কিছুটা অব্যাহত। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে ২৩ মার্চ সারা দেশে সাধারণ ছুটির ঘোষণা দেওয়া হয়। যা কার্যকর হয় ২৬ মার্চ থেকে। তার এক দিন আগেই সারা দেশে বন্ধ হয়ে যায় গণপরিবহন। সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়তে থাকে। সর্বশেষ সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আগামী ৩০ মে পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়েছে। এই ছুটি আরও বাড়বে কিনা তা এখনো অনিশ্চিত। তবে কভিড-১৯ যে লম্বা সময় ধরে অবস্থান করবে তা নিয়ে শঙ্কিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। 

ছুটির কারণে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ধাক্কা লেগেছে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোতেও। প্রথম ধাক্কাটাই লাগে মেট্রোরেল প্রকল্পে। এ প্রকল্পে কর্মরত জাপানি নাগরিকরা প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করলেও সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের কারণে প্রকল্পের দেশীয় শ্রমিকরা চলে যান নিজ নিজ এলাকায়। ফলে ২৬ মার্চের পর থেকে মেট্রোরেল প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এমআরটি লাইন-৬ এর দৃশ্যমান কাজ বন্ধ। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা অন্যান্য কাজ অব্যাহত রেখেছি। গাজীপুরে মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর স্টিল স্ট্রাকচার ফেব্রিকেশন তৈরির কাজ চলছে। এ ছাড়া যেসব কাজ ঘরে বসে করা যাচ্ছে সেগুলোও চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পে কর্মরত জাপানি নাগরিকদের ১২ জন ছাড়া সবাই প্রকল্প এলাকায়ই রয়েছেন। তবে প্রকল্পে কর্মরত দেশি শ্রমিকদের কেউই নেই। প্রায় ৯০০ শ্রমিক কাজ করেন। লকডাউনের কারণে দেশীয় শ্রমিকরা চলে যাওয়ায় দৃশ্যমান কাজ বন্ধ রয়েছে।

এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, প্রকল্পের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশি-বিদেশি শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করা। এখন আমরা দেশীয় শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। ফিরিয়ে আনাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের ফিরিয়ে এনে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখার পর কাজে যোগদান করাব। এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার পর প্রকল্প এলাকার ভিতরেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করব। তিনি আশা করছেন, ঈদের পরপরই প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ আবারও শুরু করা যাবে। তিনি আরও জানান, এই প্রকল্পে ব্যয় বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা। এম এ এন ছিদ্দিক জানান, নির্ধারিত সময়ের অন্তত আড়াই বছর আগেই এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে দুই মাস পিছিয়ে গেলেও সেটা কাভার দেওয়া সম্ভব। এমনকি ৬ মাস পর্যন্ত কাভার দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কভিড-১৯ যদি লম্বা সময় ধরে চলে তাহলে হয়তো সমস্যা দেখা দেবে। তাহলে আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।

পদ্মা সেতু রেল লিংক বাস্তবায়নের কাজ করছে রেল মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের অধীনে ঢাকার পোস্তগোলা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। করোনার কারণে এ প্রকল্পের কাজও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকল্পে কাজ করছে ৯০০ চীনা শ্রমিক এবং চার হাজার দেশি শ্রমিক। করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর দেশি শ্রমিকরা প্রায় সবাই চলে গেছেন। চায়না শ্রমিকদের মধ্যে অন্তত ১৫০ জন চীনে আটকা পড়েছেন। যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীও রয়েছেন। এ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) গোলাম ফখরুদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে কিনা এখনই বলা যাবে না। তবে সময় অবশ্যই বাড়বে। তিনি বলেন, কভিড-১৯ কতদিন পর্যন্ত থাকবে বা থাকতে পারে তার ওপর নির্ভর করবে ব্যয় বাড়বে কিনা। তবে এ প্রকল্পের কাজ যে নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না তা বলা যায়। করোনার কারণে মূল পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজেও ধীরগতি চলে এসেছে। এ প্রকল্পের চীনা শ্রমিকদের প্রায় সবাই প্রকল্প এলাকায় থাকলেও স্থানীয় শ্রমিকরা নেই। সাধারণ ছুটির পর কিছু দিন কাজ চললেও স্থানীয় শ্রমিকরা চলে যাওয়ার পর এখন কাজের গতি খুবই মন্থর বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কাজের গতি যদি এভাবে কমে যায় তাহলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যেমন কঠিন হবে, তেমনি ব্যয়ও বাড়বে বৃহৎ এই প্রকল্পে।

একই অবস্থা কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের। করোনা শুরু হওয়ার পরও এ প্রকল্পের কাজ চলছিল। কিন্তু কিছু দিন পর প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায় শ্রমিক সংকটে। সাধারণ ছুটির কারণে শ্রমিকরা কর্মস্থল থেকে চলে যায়।

দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) প্রকৌশলী মফিজুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত ১৬ মে থেকে আবার আমরা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে সীমিত আকারে কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, ঈদের পর পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারব। তিনি বলেন, যদি কভিড-১৯ দীর্ঘায়িত হয় তাহলে সমস্যা তৈরি হবে। দুই মাস হয়তো কাভার দেওয়া যাবে। কিন্তু যদি ৬ মাস হয় তাহলে সেটা কাভার দেওয়া খুবই কঠিন। তখন কাজের সময় বাড়াতে হবে। আর ব্যয়ও কিছুটা বাড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা পরবর্তীতে বোঝা যাবে কতটা বাড়বে। সরকারের এ প্রকল্পে চীনের ১৩৫ জন প্রকৌশলী কাজ করছেন। তাদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ জন চীনে অবস্থান করছেন। তাদের চলে আসার জন্য ইতিমধ্যে ই-মেইলও করা হয়েছে।

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কাউলা থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজও অনেক দিন বন্ধ থাকার পর গত সপ্তাহে খুবই সীমিত আকারে শুরু হয়েছে। প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) এ এইচ এম এস আকতার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা ৩৫ থেকে ৪০ শ্রমিক দিয়ে কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, ঈদের পর ব্যাপকভাবে কাজ করতে পারব। তিনি জানান, এ প্রকল্পে ব্যয় বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, পুরো অর্থই দিচ্ছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। তবে সময় বাড়তে পারে উল্লেখ করে আকতার বলেন, দুই-এক মাস হলে সমস্যা নেই। যদি কভিড-১৯ দীর্ঘায়িত হয় তাহলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা কঠিন হবে।

সরকারের প্রায় সব মেগা প্রকল্পেরই একই অবস্থা। বিশেষ করে চীনা অর্থায়নে ও কারিগরি সহযোগিতায় দেশে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে সেগুলোর ক্ষেত্রেই সমস্যাটা বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র জানায়, এসব প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার চীনা নাগরিক কাজ করছেন। চাইনিজ নববর্ষ উপলক্ষে প্রকল্পগুলোর চীনা কর্মীদের একটি অংশ নিজ দেশে ছুটি কাটাতে গিয়ে করোনাভাইরাসের কারণে আটকা পড়েছেন। যদিও কিছু কিছু কর্মী ফিরে এসেছেন তারপরও সংকট রয়ে গেছে। ফলে এসব বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন গতি কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর