সোমবার, ১৮ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

বিপর্যস্ত দেশের আমদানি-রপ্তানি

শিল্প উৎপাদনে স্থবিরতার আশঙ্কা, রপ্তানি আয় এপ্রিলে কমেছে ৮৩ শতাংশ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বিপর্যস্ত দেশের আমদানি-রপ্তানি

করোনাভাইরাসের কারণে দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিপর্যয় নেমে এসেছে। রপ্তানি আয় তলানিতে ঠেকেছে। কমে গেছে আমদানি পণ্যের পরিমাণও। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত এপ্রিলে দেশের রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৮৩ শতাংশ কমে গেছে। সব মিলিয়ে গত মাসে মাত্র ৫২ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। স্মরণকালে এত কম রপ্তানি আয় আর দেখা যায়নি। রপ্তানির পাশাপাশি আমদানি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন কার্যকর থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত মাসে আমদানি পণ্যের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ।  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি-রপ্তানি মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অংশ হলেও এতে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় যে স্থবিরতা তারই প্রতিফলন ঘটেছে। প্রথমে পার্শ্ববর্তী চীনে করোনাভাইরাসের প্রভাব মারাত্মক হওয়ায় জানুয়ারি থেকেই আমদানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে। কারণ বাংলাদেশের সিংহভাগ আমদানি আসে এই দেশটি থেকে। এরপর ফেব্রুয়ারি-মার্চে ইউরোপ-আমেরিকায় সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ায় রপ্তানি খাতে ধস নামে। ফলে এই দুটো খাতে একসঙ্গে নেতিবাচক প্রভাবের কারণে দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে শিল্প খাতে স্থবিরতার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেল (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে স্থবিরতা চলছে। বিশেষ করে আমাদের যে শিল্প উৎপাদন কার্যক্রম রয়েছে, লকডাউনের কারণে সেটি প্রায় থমকে গেছে এবং যে দেশগুলো থেকে আমরা আমদানি করি, বিশেষ করে চীন এবং এশিয়ার যে অন্যান্য দেশ- সেখানেও করোনাভাইরাসের কারণে শিপিং কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে একদিকে শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকায় চাহিদা কমে গেছে, পাশাপাশি শিপিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমদানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, আমদানি কমে যাওয়ার এই বিষয়টি দেশের জন্য একটি বড় ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কারণ দেশে আমদানির একটি বড় অংশ আসে শিল্পের কাঁচামাল বা মূলধনী পণ্য হিসেবে। ফলে সামনের দিনগুলোতে আমরা যে ধারণা করছি, শিল্প উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগও কমে যেতে পারে। এ ছাড়া আমাদের রপ্তানি খাতও আমদানিনির্ভর। পোশাক খাতের অর্ডার বাতিল করায় অনেক কারখানা কাঁচামাল আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। সুতরাং সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক স্থবিরতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে আমদানি ও রপ্তানি খাতে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাভাবিক অবস্থায় দেশের আমদানি-রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে। আর স্থলপথে বাণিজ্যের সিংহভাগ হয় বেনাপোল বন্দর দিয়ে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ভারতে লকডাউন চলমান থাকায় বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। মোংলা বন্দর দিয়েও পণ্য আমদানিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একমাত্র গেটওয়ে হিসেবে এখন সচল রয়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও এই প্রবেশপথ দিয়ে আমদানি ও রপ্তানি উভয় ধরনের পণ্যের পরিমাণ কমেছে।

কাস্টমস হাউস সূত্র জানিয়েছে, গত মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাণিজ্যিক ও বন্ডেড (রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্ত) পণ্য আমদানি হয়েছে ৬৭ লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন। আগের বছরের একই সময়ে একই পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ৮৪ লাখ ৩৮ হাজার  মেট্রিক টন। দেখা যাচ্ছে গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের এপ্রিলে শুধু আমদানি পণের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। এমনকি চলতি বছরের মার্চেও আমদানির পরিমাণ ছিল বেশি। ওই মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ বেশি পণ্য আমদানি হয়েছিল, যার পরিমাণ ছিল ৯৬ লাখ ১ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন। তবে এপ্রিলে এসেই বিপর্যয় শুরু হয়। দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এপ্রিলে আমদানি কমেছে ২৮ লাখ ৮০ হাজার ৩৬২ মেট্রিক টন পণ্য। আমদানির পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের পরিমাণও কমেছে ব্যাপকভাবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) তথ্য অনুযায়ী গত এপ্রিলে বাক ও কার্গো কনটেইনার মিলিয়ে মাত্র ৩ লাখ ২ হাজার ৯৯৬ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এটি আগের মাস অর্থাৎ গত মার্চের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। গত মার্চেও ৬ লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিইও এ এইচ এম আহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত জানুয়ারিতে চীনে কভিড-১৯ এর সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর এটি মার্চের মধ্যে দেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। উপরন্তু ওই সময় পশ্চিমা ক্রেতারা কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল করে। ফলে রপ্তানি খাতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ক্রয়াদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য সরকারিভাবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকা লকডউন শিথিলের দিকে যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধী মেডিকেল ইকুইপমেন্ট  রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রপ্তানি খাতের জন্য আপাতত এটিই আশার কথা।

 

সর্বশেষ খবর