সোমবার, ১৮ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

স্মৃতির আয়নায় দেশে ফেরার সেই দিনটি

তোফায়েল আহমেদ

স্মৃতির আয়নায় দেশে ফেরার সেই দিনটি

প্রতিবছর ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস সমগ্র দেশব্যাপী যথাযথ মর্যাদায় সাড়ম্বরে পালিত হয়। কিন্তু আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এবার কভিড-১৯ তথা করোনা ভাইরাসজনিত মহামারীর কারণে সেটি সম্ভবপর হয়নি। বছর ঘুরে দিবসটি যখন আমাদের জীবনে ফিরে আসে তখন স্মৃতির পাতায় অনেক কথাই ভেসে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আজ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের গৌরবময় সুনাম এবং অর্জনের এই বীজ রোপিত হয়েছিল সেদিন, যেদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা-১৯৮১’র ১৭ মে ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে-স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এ বছর তার ৪০তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকান্ডের পর আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলেছিল স্বৈরশাসকরা। সংবিধান স্থগিত করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। রাজনীতিকদের বেচা-কেনার সামগ্রীতে পরিণত করে রাষ্ট্রীয় মদদে দলভাঙার নীতি অবলম্বন করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়া সদম্ভে ঘোষণা করেছিল, ‘মানি ইজ নো প্রোবলেম’ এবং ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ানস।’ জেল, জুলুম, হুলিয়া, গুম-খুন ইত্যাদি ছিল নিত্যকার ঘটনা। প্রতিদিন সান্ধ্য আইন জারি ছিল। চারদিকে গড়ে তোলা হয়েছিল এক সর্বব্যাপী ভয়ের সংস্কৃতি। ’৭৬-এর ১ আগস্ট স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া সীমিত পরিসরে ‘ঘরোয়া রাজনীতি’ করার অনুমতি দেয়। আমরা যারা জেলে ছিলাম এবং যারা জেলের বাইরে ছিলেন তারা দলকে সংগঠিত করেন। শ্রদ্ধেয় নেতা মহিউদ্দীন আহমদকে সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক নিপীড়নের মধ্যে ’৭৭-এর ৩ ও ৪ এপ্রিল মতিঝিলের হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী সমবেত হন। মতবিরোধ নিরসন এবং দলীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার্থে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এক বছর পর ’৭৮-এর ৩ থেকে ৫ মার্চ ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। শ্রদ্ধাভাজন নেতা আবদুল মালেক উকিল সভাপতি, শ্রদ্ধেয় নেতা আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক ও কারান্তরালে থাকা অবস্থায়ই আমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়। সেই দুর্দিনে দলকে সংগঠিত করতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। দুঃসময়ের সেই দিনগুলোতে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের ভূমিকা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

’৮১-এর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন। সম্মেলনে সবাই ধরে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা জীবন-পণ চেষ্টা করে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রেখে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ওপর দলের নেতৃত্বভার অর্পণ করেছিলাম। কাউন্সিলে অনেক আলাপ-আলোচনার পর জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আমরা সাব্যস্ত করি মহান জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের পতাকা তারই হাতে তুলে দেব। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। দলের শীর্ষ পদে তাকে নির্বাচিত করে আমরা ভারতের রাজধানী দিল্লি গিয়েছিলাম এবং তার সঙ্গে পরামর্শ করে আগমন দিনটি নির্ধারণ করেছিলাম। যেদিন তিনি ফিরে এলেন সেদিন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মনে করেছিল শেখ হাসিনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকেই তারা ফিরে পেয়েছে। সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে সবার সিদ্ধান্ত অনুসারে আমরা দলীয় প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যার নাম প্রস্তাব করলে তা সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। সেদিনের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের দৃশ্য চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে। আজ যা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। সেদিন মনে হয়েছে, আমরা আবার বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাছে, যে রক্তের কাছে আমরা ঋণী,-যে ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারব না, সেই রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনার হাতে দলীয় পতাকা তুলে দিয়ে ঋণের বোঝা কিছুটা হয়তো হালকা করতে পেরেছি। সভানেত্রী হিসেবে তার নাম শুনে নেতা-কর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং বিপুল করতালির মাধ্যমে দলের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে। শেখ হাসিনা সভানেত্রী, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আবদুর রাজ্জাক এবং আমি পুনঃনির্বাচিত হই। কাউন্সিল অধিবেশনের সার্বিক সাফল্য কামনা করে তিনি একটি বার্তা প্রেরণ করে বলেছিলেন, ‘আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে এগিয়ে যান।’ বার্তাটি সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক সম্মেলনে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। দলের শীর্ষ পদ গ্রহণে তার সম্মতিসূচক মনোভাব সম্পর্কে কাউন্সিলরদের উদ্দেশে আমি বলেছিলাম, ‘আমরা সবাই একটি সুসংবাদের অপেক্ষায় আছি।’ শেখ হাসিনা তার বার্তায় সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে ‘আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির’ মাধ্যমে কাউন্সিলর ও নেতাদের বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি সোনার বাংলা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে গণবিরোধী স্বৈরশাসকের ভিত কেঁপে উঠেছিল। ’৮১-এর ১৭ মে দেশে ফিরে আসার আগে জেনারেল জিয়ার নির্দেশে ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম আমরা।

১৭ মে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বৃষ্টিমুখর দিনে শেখ হাসিনা স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। যেদিন তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না, ছিল সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ। সামরিক স্বৈরশাসনের অন্ধকারে নিমজ্জিত স্বদেশে তিনি হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা, তথা অন্ধকারের অমানিশা দূর করে আলোর পথযাত্রী। ওইদিন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭৩৭ বোয়িং বিমানে ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে সে-সময়ের ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে বিকাল সাড়ে ৪টায় এসে পৌঁছেন। সারা দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ তাকে সংবর্ধনা জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে সমবেত হয়। ওই সময় লাখো জনতা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিল, ‘শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা-স্বাগতম’; ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সঙ্গে’; ‘বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে দেব না’; ‘আদর্শের মৃত্যু নেই, হত্যাকারীর রেহাই নেই’। বিমানবন্দরে অবতরণের পর লাখ লাখ লোক তাঁকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়েছিল। সেদিন শুধু মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুই যেন শেখ হাসিনার বেশে আবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। আমরা যখন মানিক মিয়া এভিনিউতে যাই রাস্তার দুই পাশে লাখ লাখ লোক। এমন দৃশ্য যা বর্ণনাতীত। মঞ্চে উঠে তিনি শুধু ক্রন্দন করলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হৃদয়ের আবেগ ঢেলে সেদিন বলেছিলেন ‘আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই, আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী সংসার ছেলে রেখে আপনাদের কাছে এসেছি। বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি এসেছি। আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শোষণের মুক্তি। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই। স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। ওদের রুখে দাঁড়াতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করি। আপনাদের ভালোবাসার আশা নিয়ে আমি আগামী দিনের সংগ্রাম শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা না পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের ভার সরকারের কাছে নয়, আমি আপনাদের কাছে এই হত্যাকান্ডের বিচার চাই।’

শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একটানা ১৪ বছর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (তখন একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল) হিসেবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। সভাপতিমন্ডলীর সদস্য হিসেবে দলের জন্য ১৮ বছর কাছে থেকে কাজ করেছি। এছাড়াও মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে তাকে কাছ থেকে দেখেছি। আমার বারবার মনে হয়েছে যখন তার কাছে বসেছি, ক্যাবিনেট মিটিং বা সভা-সফর করেছি, তখন স্মৃতির পাতায় বঙ্গবন্ধুর কথা বারবার ভেসে উঠেছে। প্রিয় নেত্রী আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দলকে সংগঠিত করেছেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬-এ তিনি রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। আমি সেই মন্ত্রিসভার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলাম। কাছে থেকে দেখেছি দৃঢ়তা ও সক্ষমতা নিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। ‘ইনডেমনিটি বিল’ বাতিল করে সংবিধানকে কলঙ্কমুক্ত করে জাতির জনকের হত্যার বিচারকার্য শুরু করেছিলেন। ২০০১-এ বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই বিচার বন্ধ করে দেয়। আবার ২০০৮-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজই সম্পন্ন করেননি, মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ক্ষেত্র গড়ে দিয়েছেন এবং যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ায় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ প্রমাণিত হলে আদালতের রায়ে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ১১ বছরের বেশি আমরা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। ২০১৩-তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারে গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং শিল্প মন্ত্রণালয়, আর ২০১৪-তে সরকার গঠনের পর বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করি। এই ১১টি বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ অনন্য উচ্চতায় উন্নীত হয়ে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছে। জাতির জনককে আমরা ১৫ আগস্ট হারিয়েছি। নিষ্পাপ শিশু রাসেলকে সেদিন হত্যা করা হয়েছে। জাতির জনকের দুই কন্যা, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যদি সেদিন দেশে থাকতেন, খুনিচক্র তাদেরও হত্যা করত। সেদিন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠা কন্যার হাতে শহীদের রক্তে গড়া আওয়ামী লীগের পতাকা তুলে দিয়ে আমরা সঠিক কাজটিই করেছিলাম। ইতিহাস সৃষ্টি করে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। রক্তেভেজা সেই পতাকা হাতে তুলে নিয়ে দল ও দেশকে তিনি প্রগতির পথে এগিয়ে নেওয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোলমডেল। অনেক বড় বড় প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পরেও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে আজ তা সমাপ্তির পথে। মহাকাশে সফলভাবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুতে রেলপথ, বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৃথক রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ, মেট্রো রেল, এলিভেটরি এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ সর্বমোট ১১৯টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন. বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩,২০০ থেকে ২২,৭৮৭ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণ, গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি ৬৪ লাখ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, পায়রা বন্দর, গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮.১৩ শতাংশ করে জনগণের মাথাপিছু আয় ১,৯০৯ ডলারে উন্নীত করেছেন। সবল-সমর্থ আর্থ-সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করার ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশ ২০৩০ নাগাদ বিশ্বের ২৯তম ও ২০৫০ নাগাদ ২৩তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হয়ে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নেবে।’ সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নতি, জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার হার ও খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের যাবতীয় কৃতিত্বের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করেছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এত উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে যা এই ক্ষুদ্র লেখায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

২০০৮-এর নির্বাচনে ‘রূপকল্প’ তথা ‘ভিশন-২০২১’ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। রূপকল্পে ঘোষিত হয়েছিল বাংলাদেশ হবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এবং ‘মধ্যম আয়ের দেশ’। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন নয় বাস্তব। ইতোমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। ২০২০-এর ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় বছরব্যাপী ‘মুজিববর্ষ’ পালনের উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় রেখে সে-সব বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান স্থগিত করে সীমিত পরিসরে পালিত হয়েছে ও হচ্ছে। আশা করি, ২০২১-এ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে, তখন আমরা কভিড-১৯ মহামারীর দুর্যোগ কাটিয়ে পরিপূর্ণভাবে তা পালন করতে পারব। আমি আশাবাদী করোনা মোকাবিলায় আমরা সফল হব। কেননা, করোনা মহামারী মোকাবিলায় যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহীত যথাযথ পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুহার এখনো কম। শুধু তাই নয়, দেশব্যাপী লকডাউন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতেও তিনি বদ্ধপরিকর। যে জন্য দু’দফা জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ ব্যাপারে বাস্তবোচিত নির্দেশমালা প্রদান করেছেন। ব্যবসাবান্ধব সরকার প্রধান হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ৭২,৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। করোনাভাইরাসের কারণে জনসাধারণের চলাচলে যে বিধিনিষেধ জারি হয়েছে, তাতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মেহনতি মানুষের সহায়তায়কল্পে তিনি মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে ৫০ লাখ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন। এছাড়া লকডাউনের কারণে আমাদের খাদ্যোৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য তিনি বারবার নির্দেশনা দিয়ে বলছেন, ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে।’ সুখের বিষয় এবার সারা দেশে ধানের ভালো ফলন হয়েছে। ধান কাটার জন্য শ্রমিকের ঘাটতি মেটাতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধানকাটায় অংশগ্রহণ করেছেন। আমি বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্দীপনামূলক যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব নিয়ে উদয়াস্ত কাজ করছেন, তার নির্দেশিত নির্দেশমালা যদি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি, তবে এই করোনা তথা কভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধে আমরা বিজয়ী হবো। আসলে তিনি তার পিতার মতোই অন্তর থেকে যা বিশ্বাস করেন, তাই বলেন এবং বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু দুটি লক্ষ নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। সেই কাজটি দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করে চলেছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশালী ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমরা সেই পথেই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি। ইনশাল্লাহ বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ হবে। এটাই শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

[email protected]

সর্বশেষ খবর