বুধবার, ২০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

মহিমান্বিত রাত ও কিয়ামুল লাইল

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

মহিমান্বিত রাত ও কিয়ামুল লাইল

মাহে রমজানের  রাতগুলোর মধ্যে একটি রাতকে ‘শবেকদর’ বা লাইলাতুল কদর বলা হয়। সেই রাতটি বড়ই বরকত ও কল্যাণময় রাত। ওই রাতকে এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলা হয়েছে। এক হাজার মাসে ৮৩ বছর ৪ মাস হয়। ভাগ্যবান ওইসব লোক যাদের ওই রাতের ইবাদত বন্দেগি তাওফিক হয়। কেননা এই একটিমাত্র রাত যে ইবাদতে কাটিয়ে দিল সে যেন ৮৩ বছর ৪ মাসের চেয়ে বেশি সময় ইবাদতে কাটাল। আর এই বেশির অবস্থায়ও জানা নেই যে, তা হাজার মাস অপেক্ষা কত মাস অধিক উত্তম।

লাইলাতুল কদর আরবি শব্দ। শবেকদর হলো ‘লাইলাতুল কদর’-এর ফারসি পরিভাষা। ‘শব’ অর্থ রাত, আর আরবি ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থও রাত বা রজনী। কদর অর্থ সম্মানিত, মহিমান্বিত। সুতরাং লাইলাতুল কদরের অর্থ সম্মানিত রজনী বা মহিমান্বিত রজনী। এ সম্মানিত রজনীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি কোরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো, কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাস থেকেও উত্তম কল্যাণময়।’ সূরা আল কদর (১-৩)। এই সূরার শানে-নুযূল সম্পর্কে হজরত ইবনে আবী হাতেম (রা.)-এর রেওয়ায়েতে আছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বনি-ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে ব্যস্ত থাকত এবং কখনো অস্ত্র সংবরণ করেনি। মুসলমানগণ এ কথা শুনে বিস্মিত হলে এ সূরাটি নাজিল হয়। এতে এ উম্মতের জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সেই মুজাহিদের এক হাজার মাসের এবাদত অপেক্ষায় শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। আল্লামা ইবনে জাজগরীর তাবারি (র.) এই ধরনের একটি ঘটনাকে  উল্লেখ করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শবেকদর উম্মতে মুহাম্মদীরই বৈশিষ্ট্য। এই রাতটি কোন মাসে? এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মাহে রমজান এমন মাস, যাতে কোরআন নাজিল হয়েছে।’ (বাকারা-১৮৫)। প্রশঙ্গত এখানে  উল্লেখ করতে চাই, সমস্ত ঐশী কিতাব মাহে রমজানেই অবতীর্ণ হয়েছে। হজরত আবুজর গেফারি (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- তওরাতে ৬ রমজানে, ইঞ্জিল ১৩ রমজানে এবং জাবুর ১৮ রমজানে অবতীর্ণ হয়েছে। এ রাতটি রমজানের কোন তারিখে? এ সম্পর্কে আমরা পবিত্র হাদিসে পাকে পাই যে, ইমাম বুখারি ও ইমাম তিরমিজি (রহ.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কদরের রাতকে রমজানের শেষ ১০ রাতের কোনো বেজোড় রাতে খোঁজ করো।’ হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস থেকেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য কোনো কোনো উলামায়ে কেরাম নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা  ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে রমজানের ২৭ তারিখের রাতে (অর্থাৎ ২৬ রোজার দিবাগত রাতে) শবেকদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এটাকে সুনির্দিষ্ট করেননি বরং কষ্ট করে খুঁজে নিতে বলেছেন। মহান আল্লাহ চান বান্দাহ কয়েক রাত ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করে এ মহামূল্যবান রাতের সন্ধান পাক। এ রাতের আরেকটি গুরুত্ব হলো- এ পবিত্র রাতেই কোরআন নাজিল হয়েছে। আর এ কোরআনের সঙ্গেই মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। এ জন্য কদরের আরেকটি অর্থ হলো ভাগ্য। তাহলে লাইলাতুল কদরের অর্থ হয় ভাগ্যরজনী। যে মানুষ, যে সমাজ, যে জাতি কোরআনকে আমলের নিয়তে আঁকড়িয়ে ধরবে, তারা পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে সম্মানীত হবেন। এ রাতেই মানবকল্যাণে আল্লাহ মানুষের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ফেরেশতাদের জানান। আল্লাহ বলেন, ‘এ রাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয়।’ (সূরা দুখান-৪)

মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘ফেরেশতারা ও রুহ (জিব্রাইল আ.) এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয়, সে রাত পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার-ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত’ (সূরা আল-কদর ৪-৫)। হাদিসে এসেছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর কাছ থেকে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। সুবহানাল্লাহ। (বুখারি-মুসলিম)। পবিত্র শবেকদরের সঙ্গে কিয়ামুল লাইলের নিবিড় কানেকশন রয়েছে। চলুন দেখি কী কানেকশন আছে?

‘কিয়ামুল লাইল’ এর পারিভাষিক অর্থ হলো রাত্র জাগরণ। অর্থাৎ এক কথায় মহান আল্লাহর জন্য আরামের ঘুম স্বেচ্ছায় হারাম করে রাত জেগে ইবাদত করা। এভাবে ইবাদত করা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের একটি বড় গুণ।  আমরা এত সময় শবেকদরের পরিচয়, ফজিলত ও ইবাদত সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এখন চলুন আমাদের করণীয় বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। এক. এই রাতে বেশি বেশি পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত করা। দুই. নফল নামাজ আদায় করা। ন্যূনতম ১২ রাকাত থেকে যত বেশি সম্ভব পড়া। এ জন্য নফল নামাজ পড়ার নিয়মে দুই রাকাত নফল পড়ছি এই বলে তাকবির বেঁধে যত ইচ্ছা নফল নামাজ পড়া। এ নিয়তে নামাজ শুরু করে আবার সঠিকভাবে শেষও করতে হবে। এ জন্য সূরা ফাতিহার সঙ্গে নিজের জানা যে কোনো সূরা মিলালেই চলবে। এ ছাড়া সালাতুল তওবা, সালাতুল হাজত, সালাতুল তাসবিহ নামাজও আমরা পড়তে পারি। তিন. জিকির ও দোয়া : এই রাতে হাদিসে যে দোয়া ও জিকিরের অধিক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে সেগুলো থেকে কয়েকটি নির্বাচিত করে বার বার পড়া। ইস্তেগফার ও দরুদ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। কমপক্ষে ১০০ বার ইস্তেগফার ও ১০০ বার দরুদ পড়া। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে বললাম, ইয়া রসুলুল্লাহ, যদি কোনো প্রকারে আমি জানতে পারি রাতটি লাইলাতুল কদর, তাহলে কী দোয়া করব? জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন, এ দোয়া পড়বে- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন কারিমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।’ আয় আল্লাহ তুমি বড়ই মাফ করনেওয়ালা এবং বড়ই অনুগ্রহশীল। মাফ করে দেওয়াই তুমি পছন্দ করো। অতএব তুমি আমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দাও।

চার. মুনাজাত : মুনাজাতের মাধ্যমে বান্দার বন্দেগি ও আল্লাহর রবুবিয়াতের প্রকাশ ঘটে। বান্দাহ তার প্রভুর কাছে চায়। প্রভু এতে ভীষণ খুশি হন। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি এতটাই অনুগ্রহশীল যে, তিনি তাঁর কাছে না চাইলে অসন্তুষ্ট হন। ‘যে আল্লাহর কাছে কিছু চায় না আল্লাহ তার ওপর রাগ করেন।’ (তিরমিজি)। কাজেই আমরা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করব, মাগফিরাত চাইব, রহমত চাইব, জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাইব। মনের আবেগ নিয়ে চাইব। চোখের পানি ফেলে চাইব। আল্লাহ আমাদের খালি হাতে ফেরাবেন না ইনশাআল্লাহ। মহান রব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে কায়মনোবাক্যে এই বরকতময় রাতে বেশি বেশি ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির, খতিব ও টিভির ইসলামী প্রোগ্রাম উপস্থাপক।

সর্বশেষ খবর