বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

উপকূলে আম্ফানের আঘাত

ছয়জনের মৃত্যু, জলোচ্ছ্বাসে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি, আশ্রয় কেন্দ্রে ২৪ লাখ মানুষ, বিদ্যুৎহীন ১০ লাখ, তাণ্ডব কমিয়েছে সুন্দরবন

নিজস্ব প্রতিবেদক

উপকূলে আম্ফানের আঘাত

নোয়াখালীর হাতিয়ার নলচিড়া ইউনিয়নে উঁচু জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। বাগেরহাটে সড়ক উপচে ঢুকছে পানি [ডানে] -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। গতকাল বিকাল ৪টা থেকে এটি সাগর উপকূলের পূর্ব দিকে সুন্দরবন ঘেঁষা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দিয়ে অতিক্রম করে। চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তা-ব চালিয়ে রাত ৮টার দিকে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে আম্ফান সাতক্ষীরা, খুলনা অঞ্চল অতিক্রম করে। আরেক দফায় সুন্দরবন বুক পেতে দিয়ে অনেকাংশে ঠেকিয়ে দেয় আম্ফানের তা-ব। পরে ১০০ কিলোমিটারের কম গতি নিয়ে এটি স্থলে নিম্নচাপে পরিণত হয়। অবশ্য এর আগেই প্রবল বাতাসে কাঁচা ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়। স্বাভাবিকের চেয়ে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে যায় ফসল। আম্ফানের প্রভাবে উত্তাল ছিল সাগর ও নদী। মোংলাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে ৮-১০ ফুট জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভোলায় গাছ চাপা ও ট্রলারডুবিতে দুজন নিহত এবং পটুয়াখালীতে নৌকাডুবিতে এক উদ্ধারকর্মী ও গাছ চাপায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে বরগুনায় একজন এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে জোয়ারের পানিতে ডুবে একজনের মৃত্যু হয়।  ঢাকার আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে সুন্দরবন ঘেঁষে আম্ফান স্থলভাগে উঠে এসেছে। উপকূল পেরিয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে আম্ফান স্থলভাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বৃষ্টি ঝরিয়ে এর শক্তি ক্ষয়ে আসার কথা জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। তারা জানিয়েছেন, আম্ফানের একটি অংশ বাংলাদেশের সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চল দিয়ে ঢুকে যশোর ও নড়াইল জেলার ওপর দিয়ে রাতেই চলে যাওয়ার কথা। এ পর্যন্ত এর বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটারের মতো হওয়া কথা। সেখান থেকে রাত ১২টা থেকে ১টার দিকে মাগুরা, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জ থেকে জামালপুরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা। ভূখন্ডে আম্ফানের স্থল নিম্নচাপে রূপ নেওয়ার মধ্য দিয়ে আম্ফানের নাম মুছে যাবে। পরে ময়মনসিংহ হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গিয়ে হারিয়ে যাবে স্থল নিম্নচাপটি। এর প্রভাবে আজও বৃষ্টি হবে। আগামীকাল দেখা যাবে ঝলমলে রোদ।

বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, গতকাল ঝড় শুরু হওয়ার আগেই সুন্দরবন ৩ ফুট পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর দিয়েছে বন বিভাগ। পানির তোড়ে বিকালে শরণখোলা উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পুরনো বেড়িবাঁধ ভেঙে শরণখোলা গ্রামের ১৫০টি পরিবারের বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। সড়কের ওপর দিয়ে পানি উপচে বাগেরহাট সদরের রহিমাবাদ ও চাঁপাতলা গ্রামের ১৫০ পরিবার ইতিমধ্যেই পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের মহাবিপদ সংকেতের মধ্যে থেকে থেকে ভারি বৃষ্টি ও অন্ধকারাচ্ছন্ন গুমোট আবহাওয়ায় সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মোংলা বন্দর কর্র্তৃপক্ষ বন্দরে অ্যালার্ট-৪ জারি করে বন্দরে অবস্থানরত ১০টি জাহাজকে বন্দরের মূল চ্যানেল থেকে সরিয়ে হারবাড়িয়া পয়েন্টে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে। বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা চালাতে জরুরি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে মোংলা বন্দর জেটিতে অবস্থান নেয় নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের ৮টি যুদ্ধজাহাজ। সন্ধ্যার পরে সুন্দরবনের হিরণপয়েন্ট, ধুবলা, কটকায় আঘাত হানে। কটকা, ধুবলা চরাপুটিয়া ও কোকিল মোনি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এই চার বনবিভাগের অফিসে কয়েকশ হরিণ এসে আশ্রয় নেয়।

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে সুন্দরবন সংলগ্ন কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া, মরিচপাচসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ২ থেকে ৩ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। সকাল থেকে হালকা দমকা হওয়ার সঙ্গে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ও গাবুরা, মুন্সীগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলার গয়ারঘাট, হাজরাকাটি, কুড়িকাউনিয়া, মনিপুরী ও বিছট এলাকার বেড়িবাঁধে ভয়াবহ ফাটল দেখা দিয়েছে। শ্যামনগর ও আশাশুনির বিভিন্ন ইউনিয়নের বিশেষ করে গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, প্রতাপনগর, আনুলিয়া, খাজরা ও শ্রীউলা ইউনিয়নে ৪৫টিরও বেশি পয়েন্টে বে?ড়িবাঁধ ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এরই মধ্যে গাবুরার নেবুবুনিয়া, নিজামিয়া মাদ্রাসার সামনে ও পদ্মপুকুরের চাউলখোলা, খুটিকাটা, কামালকাটি ও চন্ডিপুরে কপোতাক্ষ এবং খোলপেটুয়ার পানি বেড়িবাঁধ উপচে পড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু গাছগাছালি উপড়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় রাতের জোয়ার। উপকূলবাসী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়া বেড়িবাঁধ রাতের জোয়ারে টিকবে কিনা তা নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছে। সুন্দরবনের সীমান্ত নদী কালিন্দী ও মাদার নদীর পানি ফেঁপে বনে ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে উপকূলীয় এলাকার শত শত চিংড়ি ঘের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঘেরের ছোট ছোট রিং বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে চিংড়ি চাষিরা জানিয়েছেন। খুলনা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় এলাকা দাকোপের সুতারখালী, কালাবগী ও নলিয়ানের নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। গতকাল দুপুরের মধ্যে ৪-৫ ফুট পানির উচ্চতায় এখানকার বেড়িবাঁধের বাইরের অংশে ঝুলন্তপাড়া নামক এলাকায় ৫ শতাধিক বাড়িঘর, মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে যায়। এ ছাড়া জোয়ারের পানির চাপে কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সুতারখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাছুম আলী ফকির জানান, বুধবার সকাল থেকে সুতারখালী কালাবগী এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় নদীর পানি ৪-৫ ফুট উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। এতে বেড়িবাঁধের বাইরের অংশের বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। দুর্ভোগে পড়ে এখানকার মানুষ। এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কয়রার উত্তর বেদকাশী দক্ষিণ বেদকাশী আংটিহারা ও গোলখালী এলাকায় জোয়ারের পানি বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে লোকালয়ে ঢুকেছে। এখানকার প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করেছে। তবে যে কোনো সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, সুপার সাইক্লোন ‘আম্ফান’-এর কারণে পটুয়াখালীর উপকূলজুড়ে বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করে। কুয়াকাটা সংলগ্ন সাগর ছিল উত্তাল। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে তিনটি উপজেলার ১৭টি গ্রাম। কলাপাড়ায় জনসচেতনে প্রচার কাজ চালাতে গিয়ে নৌকা ডুবে সকাল ৮টার দিকে নিখোঁজ সিপিপির দলনেতাকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। চরাঞ্চলসহ দুর্গম অঞ্চলের কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি ছেড়ে বেশ কিছু মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। আম্ফান ও অমাবস্যার জোর প্রভাবে উচ্চ জোয়ারে নদী-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৪ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশ কিছু চরসহ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের ৫টি, গলাচিপা উপজেলার চালিতাবুনিয়া, চরকাজল এলাকার ৫টি ও রাঙ্গাবালী উপজেলায় চরমোন্তাজ ও চরআন্ডার ৭টি গ্রামের বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে ১৭টি গ্রাম তলিয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও বেশ কিছু গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে।

বরগুনা প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে বরগুনার প্রধান তিনটি নদীতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলের শত শত ঘরবাড়ি। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময় জোয়ারের উচ্চতা থাকে ২.৮৫ সেন্টিমিটার। বুধবার বেলা ১১টায় বরগুনায় জোয়ারের পানির উচ্চতা ছিল ৩.১৮ সেন্টিমিটার। যা বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাতে পানির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে, সেই সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা তাদের। ভোলায় গাছ চাপা ও ট্রলারডুবিতে দুজন নিহত : ভোলা প্রতিনিধি জানান, ভোলার চরফ্যাশনে গাছ চাপা পড়ে এক বৃদ্ধ এবং মেঘনা নদীতে ট্রলার ডুবে একজন নিহত হয়েছে। বুধবার দুপুরের পর থেকে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী উত্তাল হয়ে ওঠে। জোয়ারের পানি কয়েক ফুট বেড়ে যাওয়ায় বেড়িবাঁধের বাইরের এবং বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। জোয়ারের পানি কয়েক ফুট বেড়ে যাওয়ায় বাঁধের বাইরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চরাঞ্চলের অনেক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।  ঘূর্ণিঝড় আম্ফান উপকূলে আঘাত হানার আগেই ভোলার চরফ্যাশনে ঝড়ো বাতাসে গাছ ভেঙে পড়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার প্রধান সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে দক্ষিণ আইচা থানার ওসি হারুন অর রশিদ জানান। তিনি বলেন, নিহত ছিদ্দিক ফকির (৭০) দক্ষিণ আইচা এলাকারই বাসিন্দা। বয়স্ক ভাতা আনার জন্য ভাড়া করা মোটরসাইকেলে তিনি উপজেলা সদর চরফ্যাশনের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় ঝড়ে একটি গাছ ভেঙে পড়লে তিনি গুরুতর আহত হন। উদ্ধার করে চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শোভন কুমার বসাক জানান, ওই বৃদ্ধকে হাসপাতালে আনার পর তার শ্বাসকষ্ট দেখা যায়; মাথায়ও গুরুতর আঘাত ছিল। অক্সিজেন দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। অপরদিকে লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীর ঘাট থেকে ৩০ জন যাত্রী নিয়ে ট্রলারযোগে উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিয়ে ভোলায় আসার সময় রাজাপুর এলাকায় কূলের কাছাকাছি এসে ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলারটি ডুবে যায়। এতে রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার বাড়ি বোরহানউদ্দিন উপজেলার মনিরাম এলাকায় বলে জানা গেছে।

নৌকাডুবিতে সাহায্যকর্মী ও গাছ চাপায় শিশুর মৃত্যু : পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মো. শহিদুল হক জানান, দুর্গম এলাকার মানুষকে নিরাপদে সরে যেতে সকালে কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের ৬ নং ইউনিটের সিপিপির দলনেতা মো. শাহআলমের নেতৃত্বে মাইকে প্রচার চালাতে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়ার সময় ছৈলাবুনিয়া গ্রামের হাফেজ প্যাদা নামক একটি বদ্ধ খাল পারাপারের সময় নৌকাটি উল্টে ডুবে গেলে চারজন ভলান্টিয়ার পানিতে পড়ে ডুবে যায়। এতে দলনেতা শাহআলম নিখোঁজ হন। এ সময় তার সঙ্গে থাকা অপর তিনজন ভলান্টিয়ার সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। ফায়ার কর্মীরা চেষ্টা চালিয়েও তাকে খুঁজে পায়নি। তবে বরিশাল থেকে ডুবুরি দল ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। সন্ধ্যায় শাহ আলমের মৃত্যুর খবর জানান জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী। সন্ধ্যায় গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি এলাকায় ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে ছয় বছরের শিশু রাসেদ মারা গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন ওসি মো. মনিরুল ইসলাম। আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে মৃত্যু : মঙ্গলবার রাতে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে বরগুনার সদর উপজেলার পরীরখাল এলাকার মো. শহিদুল ইসলাম (৬৫) নামের এক হোটেল ব্যবসায়ী হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এম বালিয়াতলী ইউপি চেয়ারম্যান শাহ নেওয়াজ সেলিম জানান, ওই বৃদ্ধ অসুস্থ ছিলেন। তিনি আম্ফানের কারণে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পরীরখাল আশ্রয় কেন্দ্রে আসছিলেন। আসার পথে অসুস্থতা বেড়ে গেলে রাত ১০টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। বুধবার সকালে নিহতের পরিবারের বাড়ি গিয়ে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা আক্তার। জোয়ারের পানিতে ডুবে যুবকের মৃত্যু : দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. সালাউদ্দিন (১৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। দুপুরের দিকে সন্দ্বীপ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সন্দ্বীপ থানার পরিদর্শক তদন্ত মো. সোলাইমান জানান, উপকূলে ঘাস কাটতে গিয়ে ওই যুবক জোয়ারের পানিতে পড়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তার মরদেহ উদ্ধার করে। ওই যুবক নদীর একেবারে কাছে চলে যাওয়ায় অসাবধানতার কারণে পানিতে পড়তে পারেন। বঙ্গোপসাগরে আছড়ে পড়ছে ঢেউ : ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগর। বিশাল আকৃতির ঢেউ উপকূলে আছড়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে লোকালয়ে সাগরের পানি ঢুকে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গতকাল ভোর থেকেই বিশাল আকৃতির ঢেউ আছড়ে পড়ছে উপকূলীয় এলাকায়। একেকটি ঢেউর উচ্চতা ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত হয়েছে। অমাবস্যার সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাব যুক্ত হওয়ায় বঙ্গোপসাগর ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। 

আশ্রয় কেন্দ্রে ২৪ লাখ মানুষ : ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে ২৩ লাখ ৯০ হাজার ৩০৭ জন মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া ৫ লাখ ১৭ হাজার ৪৩২টি গবাদিপশুকে নিরাপদ স্থানে সরানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবিলায় সরকারের সবশেষ প্রস্তুতি নিয়ে গতকাল সচিবালয় থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, একটি লোককেও যেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ছেড়ে না আসা হয় আমরা সেই নির্দেশ দিয়েছি। লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা ১২ হাজার ৭৮টি থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার ৩৩৬টি করা হয়েছে জানিয়ে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ২৩ লাখ ৯০ হাজার ৩০৭ জনকে নেওয়া হয়েছে, এটাই এ যাবৎকালের ‘সর্বোচ্চ সংখ্যা’। এর আগে ঘূর্ণিঝড় ফণীর সময় ১৮ লাখ এবং বুলবুলের সময় ২২ লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের পাশাপাশি ৫ লাখ ১৭ হাজার ৪৩২টি গবাদিপশুকেও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। জরুরি ওষুধসহ মেডিকেল টিম প্রস্তুত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছেন তাদের মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ করা হয়েছে। আশা করছি, আমরা আম্ফান থেকে রক্ষায় সর্বোচ্চ সফলতা পাব। ভাষাণচরের ১২০টি শেল্টারের মধ্যে একটিতে কিছু মানুষকে রাখা হয়েছে জানিয়ে এনামুর বলেন, তাদের তদারকিতে নৌবাহিনী রয়েছে, তাদের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মাঠে স্বাস্থ্যকর্মীদের ১৯৩৩টি দল :  ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষায় উপকূলের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই নেওয়া মানুষের জরুরি চিকিৎসা সহায়তা প্রদানে স্বাস্থ্যকর্মীদের ১ হাজার ৯৩৩টি দল কাজ করছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান খান গতকাল দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য দেন বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে এক হাজার ২১২টি, খুলনায় ৩০৩টি ও বরিশালে ৪১৮টি স্বাস্থ্য টিম রয়েছে। এই টিমগুলো আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া ১৪ থেকে ২০ লাখ মানুষের ওষুধ সরবরাহসহ জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করবে।

নোয়াখালীতে বেড়িবাঁধ ভেঙে ৫ শতাধিক বাড়িঘরে পানি : ঘূর্ণিঝড় আম্ফান উপকূল ভাগে আসার আগেই ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে নোয়াখালীতে ‘অস্বাভাবিক জোয়ারে’ বেড়িবাঁধ ভেঙে পাঁচ শতাধিক বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। এ ছাড়া কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের নিচতলায় পানি এসেছে। গতকাল দুপুরের দিকে জেলার হাতিয়া উপজেলার চরঈশ্বর, নিঝুম দ্বীপ ও সোনাদিয়া ইউনিয়নে এই ক্ষয়ক্ষতির খবর জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। চরঈশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রাশেদ উদ্দিন বলেন, আমার এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে ও ভিতরে পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। তবে লোকজনকে আগেই সরিয়ে নেওয়ায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। উপজেলার নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন বলেন, তার ইউনিয়নে অস্বাভাবিক জোয়ারের চাপে ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। এতে অনেক বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ স্থানীয় আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। সোনাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নূরুল ইসলামও তার ইউনিয়নে ‘অস্বাভাবিক জোয়ারে’ কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর দিয়েছেন। ১০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন : ঘূর্ণিঝড় আম্ফান বাংলাদেশ উপকূলে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ না চালালেও এর প্রভাবে উপকূলীয় এলাকাগুলো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া ঝড়ো হাওয়ার প্রভাবে গাছ পড়ে, তার ছিঁড়ে পড়াসহ বিভিন্ন কারণে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে উপকূলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অন্তত ১৭টি সমিতির ১০ লাখের বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর বাইরে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বা ওজোপাডিকোর প্রায় ৪০ হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। সংযোগ মেরামতের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রয়েছে জানিয়ে বিতরণ সংস্থাগুলো বলছে, ঝড় থেমে গেলে বৃহস্পতিবার বিকালের মধ্যে মেরামত করে সংযোগগুলো চালু করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর