বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

কৃষি উৎপাদনে এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব

জাহাঙ্গীর আলম

কৃষি উৎপাদনে এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব

ড. আবদুর রাজ্জাক

কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, কভিড-১৯ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কৃষিমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নানা পরিকল্পনা ও কৃষি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

ড. আবদুর রাজ্জাক একজন কৃষি বিষয়ক গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। ২০১৯ সাল থেকে তিনি কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাবেক ছাত্রনেতা ড. আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, কভিড-১৯-এর কারণে কৃষি ও খাদ্য বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে। এমনকি দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে। তাদের এই আশঙ্কা আগাম বিবেচনায় নিয়ে দেশকে খাদ্যে উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত করার মাধ্যমে খাদ্য রপ্তানির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, আবাদযোগ্য এক ইঞ্চি জায়গাও খালি রাখা যাবে না। তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয় সর্বাত্মকভাবে কাজ করছে। তিনি বলেন, সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে এবার বোরোর সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া গেছে। ধানের দামও ভালো। ফলে কৃষক লাভবান হচ্ছে। হাওরে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ। কৃষিমন্ত্রী বলেন, হাওরে ধান কাটা নিয়ে সবসময়ই একটা ঝুঁকি থাকে। এবারও আগাম বন্যার পূর্বাভাস ছিল। কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে ধান কাটার শ্রমিক সংকট ছিল। কিন্তু সরকার উদ্যোগ নিয়ে ভর্তুকি মূল্যে প্রায় হাজার খানেক ধান কাটার যন্ত্র হাওরাঞ্চলে সরবরাহ করে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় শ্রমিক সংকটের সমাধান হয়। তাছাড়া ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ ধান কাটায় সহযোগিতা করেছে। ফলে কৃষক শতভাগ ধান ঘরে তুলতে পেরেছে। ড. রাজ্জাক বলেন, গত নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা বলেছি, কৃষিকে আমরা যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ করব। এখন জমি চাষ, ধান মাড়াই, ধান কাটায় যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এই কৃষি যন্ত্র ক্রয়ে কৃষকদের সমতলে ৫০ ভাগ এবং প্রতিকূল এলাকায় ৭০ ভাগ প্রণোদনা দেওয়া হয়। সারের দাম কমানো হয়। কৃষি ঋণ বাড়ানো হয়। ফলে কৃষিবান্ধব পরিবেশ পাওয়ায় সব কৃষি পণ্যের উৎপাদন বাড়ে। তিনি বলেন, আমাদের আলুর উৎপাদন ব্যাপকহারে বেড়েছে। গড়ে বছরে আমাদের ৬০-৭০ লাখ মেট্রিক টন আলুর প্রয়োজন হয়। আর উৎপাদন হয় এক কোটি থেকে এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। মন্ত্রী বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মাত্র একটা ফসল উৎপাদন হতো। লবণাক্ত জমিতে ফসল হয় না। আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা লবণাক্ত সহিষ্ণু ধান জাত উৎপাদন করায় সেসব অঞ্চলেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ধান উৎপাদন হচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজু বাদাম চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত বছর এ অঞ্চলে কাজুবাদামের চার হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, পার্বত্য অঞ্চলে কাজু বাদামের বাণিজ্যিক চাষ হবে। কৃষিমন্ত্রী বলেন, এবার ৩৫ লাখ মেট্রিক টন আউশ ধান উৎপন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যে কারণে আবাদের এলাকা বাড়িয়েছি। কৃষকদের বিনা পয়সায় সার ও বীজ দিচ্ছি। ভারত থেকে উন্নত জাতের পাটের বীজ এনে দিয়েছি। গ্রীষ্মকালীন সবজি এবং তিল আবাদের বিশেষ কর্মসূচি নিয়েছি। তিনি বলেন, আগামী জুলাই থেকে আমন মৌসুম শুরু হবে। ফলে এখন থেকেই বীজ তলা তৈরির জন্য কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া গম, ভুট্টা, সরিষা, কলাই উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মৌসুমি ফল বিপণনে কৃষকদের সহায়তা করা সম্পর্কে কৃষিমন্ত্রী বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে আম ও লিচু বাজারজাত করার লক্ষ্যে কয়েকজন মন্ত্রী, সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, কৃষি ব্যক্তিত্ব, চাষি, পরিবহন শ্রমিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ভিডিও কনফারেন্স করেছি। কৃষকরা যাতে ন্যায্য মূল্য পান তার জন্য আম ও লিচু পরিবহন নির্বিঘ্ন করার সবরকম উদোগ নেওয়া হয়েছে। এমনকি আইসিটি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে নানারকম তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করার আগ্রহ দেখিয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আম ও লিচু পরিবহনে ফেরি পারাপারে সহায়তা করবে। রেলওয়ে মৌসুমি ফল পরিবহন করবে। বঙ্গবন্ধু সেতু পারাপারে টোল কমানোর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন আম প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলোকে বেশি বেশি আম কেনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ চিরদিন একটা খাদ্য ঘাটতির দেশ ছিল। ঘাটতি মেটাতে আমাদের হয় আমদানি করতে হতো অথবা খাদ্য সহায়তা নিতে হতো। তাছাড়া কৃষি সবসময় প্রকৃতি নির্ভর। এ কারণে খাদ্য উৎপাদনে সবসময় একটা ঝুঁকি থাকে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে সব সরকার কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কেউ বরাদ্দ দেয়নি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। এমনকি তিনি তৎকালীন পূর্ব জার্মানি থেকে বিমানে করে সেচ যন্ত্র আনেন। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আর কৃষি গুরুত্ব পায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে কৃষিকে গুরুত্ব দেয়। ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু ২০০১ সালের পর আবার খাদ্য উৎপাদন নিম্নমুখী হয়। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর কৃষিতে একটা সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়। কৃষি ও সারে ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়ায় ২০১৩ সালের মধ্যে দেশ দানা জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। তাছাড়া আলু, ডাল ও শাক-সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। গবেষকরা নতুন নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেন। কৃষিতে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর