শুক্রবার, ২৯ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

সংকটের শেষ নেই হাসপাতালে

বিনা চিকিৎসায় সাবেক সিভিল সার্জন ও হাসপাতালের গেটে অপেক্ষা করতে করতেই ব্যাংকারের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে হাসপাতালগুলোতে সেবা বঞ্চনা দিন দিন বেড়েই চলছে। সেই সঙ্গে প্রতিদিনই বাড়ছে হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট নানা ধরনের সংকট। নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েও থামানো যাচ্ছে না সংকট। ফলে কভিড-১৯ আক্রান্তরা যেমন হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। আবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হয়ে চিকিৎসা অবহেলায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন সাধারণ রোগীরাও।

জানা যায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হলে জনতা ব্যাংকের সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার অশোক কুমার দাসকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর আসগর আলী হাসপাতালে।  হাসপাতালটিতে নেওয়ার পর কোনোই চিকিৎসা দেওয়া হয়নি তাকে। ফলে অশোক কুমার দাস বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বলে অভিযোগ করেছেন সদ্য বিদায়ী অতিরিক্ত সচিব মানিক চন্দ্র দে। তিনি বলেন, চরম দায়িত্বহীনতার শিকার হলো আমার একমাত্র ছোটবোনের স্বামী অশোক কুমার দাস। তীব্র হার্ট অ্যাটাক নিয়ে মঙ্গলবার রাত ২টার সময় দেশের একটি বড় হাসপাতাল আসগর আলীতে। কিন্তু আমি একজন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব এবং এলাকার বাসিন্দা পরিচয় দেওয়ার পরও এবং বার বার করোনা রোগী না বলা সত্ত্বেও তাকে কোনো জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হলো না। হাসপাতালের বাইরে অ্যাম্বুলেন্সে রেখেই ছোট একটা কার্ডিয়াক সেন্সর দিয়ে টেস্ট করে (না অক্সিজেন, না ভিতরে নিয়ে পরীক্ষা) রোগীর পালস পাওয়া যাচ্ছে না বলল। মৃতও ঘোষণা করল না, সার্টিফিকেটও দিল না। তারা বাইরে গাড়িতেই রেখে দিল। অথচ নর্মাল সময়ে সামান্য চিকিৎসা দিয়ে কত বিপুল টাকা রোগীদের কাছ থেকে নিয়ে নেয় এ হাসপাতালটি। এ হলো আমাদের হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার নমুনা। আমাদের মতো অনেক ভুক্তভোগীকেই এ পরিণতি মেনে নিতে হচ্ছে।’ অন্যদিকে, সিলেটে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন মৌলভীবাজারের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. এম এ মতিনও। সাবেক সিভিল সার্জনের মেয়ে নর্থ-ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাবেয়া বেগম বাবাকে নিয়ে একের পর এক হাসপাতালে ঘুরেও কোনো চিকিৎসা পাননি। সাবেক এই সিভিল সার্জন মারা যাওয়ার পর চিকিৎসার ভোগান্তি নিয়ে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন তাঁর মেয়ে। স্ট্যাটাসে ডা. রাবেয়া বেগম লিখেছেন, ‘অসুস্থ হয়ে পড়ার পর বাবাকে নিয়ে মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তাদেরকে নানাভাবে আকুতি-মিনতি করলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভর্তি করেনি। পরে আমার বাবাকে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য সুপারিশ করেন। আমরা বাবাকে নিয়ে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের দরজায় আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর ডাক্তার এসে বললেন, ১ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যান। তখন চিকিৎসক বাবাকে নিয়ে আমি পাগলের মতো ছুটছি; কেউ ১ নম্বর ওয়ার্ড বলে দেওয়ার বা দেখিয়ে দেওয়ার নেই। আমি নিজেই ট্রলি টেনে ওয়ার্ডে গেলাম। নোংরা বেডে আমার বাবাকে নামালাম। এরপর চিকিৎসক এসে অক্সিজেন মাস্ক কিনে আনার জন্য বললেন। এদিকে অক্সিজেনের নীল গাড় হচ্ছে; তখন কতশত ডাক্তারকে ফোন দিলাম, কেউ ধরল না। আমি শুধু অক্সিজেন নিয়ে বসে রইলাম। গাইনি বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক আরও বলেন, তারপর সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউনুছুর রহমানের কাছে ফোন গেলে তিনি খুব সহযোগিতা করেছেন। তাঁর আদেশের একঘণ্টা চলে যাওয়ার পর ওয়ার্ডবয় এসে বলল, রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ট্রলি কে ঠেলবে? তখন আমি জবাব দিলাম আমিই ট্রলি নিয়ে যাচ্ছি। বেলা ২টায় ডাক্তার এলেন। এসে আমাকে বললেন, আইসিইউ বেড অকুপাইড। আমি চাইলে একটা বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু রোগীর যে-অবস্থা তাতে লাভ হবে না। অথচ আমার বাবা সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। চাকরিজীবনে তিনি সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য নানা চেষ্টা করেছেন। আর তিনিই কী-না শেষ বেলা এমন অবহেলার শিকার হলেন। আর বিশটি বছর দেশের মানুষের জন্য কাজ করে আজ জানলাম আমি এ দেশের এক অনাকাক্সিক্ষত সন্তান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর