সোমবার, ১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

উপসর্গ নিয়ে প্রাণ গেল আরও ৩৭ জনের

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গতকাল ২২ জন রোগী মারা গেছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্টের মতো করোনা উপসর্গ নিয়ে আরও ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলে করোনা উপসর্গ নিয়ে গতকাল মোট ৩৭ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে চাঁদপুরে তিনজন, ফেনীতে দুজন, মাদারীপুরে একজন, বরিশালে তিনজন, পিরোজপুরে একজন, চট্টগ্রামে একজন, রাজশাহীতে একজন, কিশোরগঞ্জে একজন, যশোরে একজন ও দিনাজপুরের একজন মারা যান। তাদের মধ্যে একজন মাত্র ১০ মিনিট আইসোলেশনে থেকে মারা যান। আবার অনেকের করোনা পরীক্ষা করা হলেও ফলাফল পাওয়ার আগেই মারা গেছেন। সংশ্লিষ্টদের বাড়িঘরও লকডাউন করেছে প্রশাসন। করোনা সন্দেহে পরিবারের সদস্যদের নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে। অনেককেই হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল ২২ জনের মৃত্যু : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে শনিবার বিকাল ৪টা থেকে গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজনের শরীরে করোনা পজিটিভ ছিল। সবাই করোনা  সন্দেহ ও উপসর্গ  নিয়ে মারা গেছেন। তারা হলেন- মো. আবদুল কুদ্দুস (৫৫),  ইমদাদুল হক  (৬০), জসিম উদ্দিন (৪৫), তাসলিমা (৪০), লুৎফুর রহমান (৫৫), আমীর হোসেন (৫৪), বেবী আকতার (৩৬), দিলীপ সাহা (৬৮), খাজা মুনসুর (৮৫), সিরাজুল ইসলাম (৭০), আনোয়ার হোসেন (৮৩), মনিরুজ্জামান (৪৮), শারমিন ইসলাম (৩২), রাহিমা (৬৫), সুভাষ (৫৫), আবুল খায়ের (৬৫), রোজীনা (১৮), স্বপন (৩২), নাবীর হোসেন (৬৫), সেতারা কবীর (৬৫), মিলন (৫০) ও রেশমা (৩০)।

জেলায় জেলায় ১৫ জনের মৃত্যু : আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যানুযায়ী- চাঁদপুরে গতকাল তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তির পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজন মারা গেছেন। গতকাল সকালে একজন এবং বিকালে অপরজন মারা যান। তাদের দুজনের বাড়ি হাজীগঞ্জে। এর মধ্যে একজনের বাড়ি হাজীগঞ্জ উপজেলার বাকিলা এলাকার সাতবাড়িয়া গ্রামে এবং অপরজনের বাড়ি একই উপজেলার মকিমাবাদ এলাকায়। সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল জানান, করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে গতকাল সকাল ১০টার দিকে হাসপাতালে আসেন সাতবাড়িয়া গ্রামের একজন। আইসোলেশনে ভর্তির পর সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের সময় মারা যান তিনি। তার নমুনা সংগহ করা হয়েছে। অন্যদিকে বিকাল ৩টার সময় মকিমাবাদ থেকে ৬৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ একই উপসর্গ নিয়ে সদর হাসপাতালের আইসোলেশনে ভর্তি হন। তাকে অক্সিজেন দেওয়ার পরপরই তিনি মারা যান বলে জানান তিনি। তিনি মাত্র ১০ মিনিট আইসোলেশনে ছিলেন। আর গতকাল দুপুরে হাজীগঞ্জে করোনা উপসর্গ নিয়ে রফিকুল ইসলামের (৪৮) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। হাজীগঞ্জ পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ড ধেররা-বিলওয়াই গ্রামে নিজ বাড়িতে মারা যান। হাজীগঞ্জে ১১ জন মিলে করোনাকালে মৃতদেহ দাফনের কাজ করতেন। তাদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম একজন ছিলেন। তিনি হাজীগঞ্জ বাজারের আল আকসা টেইলার্স ‘রফিক ভাই’ বলে সবার কাছে বেশ পরিচিত। শিক্ষক শরীফুল হাছান বলেন, গতকাল সকালে রফিক ভাইয়ের শরীর অসুস্থবোধ করেন। নিজেই ছেলেকে নিয়ে বাজারে গিয়ে কয়েকজনের ঋণের টাকা পরিশোধ করেন। পরে বাসায় গিয়ে দুপুর ১টায় মারা যান।

ফেনী সদর হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার রাতে ৮০ ও ৬০ বছর বয়সী এ দুজন মারা যান বলে হাসপাতালের আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (আরএমও) ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দুজনেরই বাড়ি সদর উপজেলায়। দুজনকেই শনিবার রাতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকায় মৃত্যুর পর তাদের পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

মাদারীপুর সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক তরুণের (২১) মৃত্যু হয়েছে। করোনা শনাক্তের পরীক্ষার জন্য তার নমুনা পাঠানো হয়েছিল। তবে পরীক্ষার প্রতিবেদন আসার আগেই গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় তিনি মারা যান। তিনি জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও গলাব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই তরুণ ঢাকার কালীগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। ঈদের চার দিন আগে ঢাকা থেকে গ্রামে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সূত্র জানায়, শনিবার করোনাভাইরাসের উপসর্গ জ্বর, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি হন ওই তরুণ। ওই দিনই তার দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হয়। গতকাল ভোর থেকে তার শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তিনি মারা যান।

সাড়ে চার ঘণ্টায় তিন মৃত্যু : বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে গতকাল সাড়ে চার ঘণ্টায় আরও তিন রোগী মারা গেছেন। শনিবারও ওই হাসপাতালের করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে ১২ ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের ব্যবধানে তিনজন মারা গিয়েছিলেন। গতকাল মারা যাওয়া তিনজনের প্রথম জন বেলা সোয়া ১১টায়, দ্বিতীয়জন বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে এবং এর পাঁচ মিনিট পরই তৃতীয়জন মারা যান। হাসপাতালের পরিচালক মো. বাকির হোসেন বলেন, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের নমুনা সংগ্রহ করে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের করোনা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। তিনজনই খুব খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিলেন। পুরো বিষয়টি নিয়ে আমরাও আতঙ্ক আর উদ্বেগের মধ্যে আছি। মারা যাওয়া তিনজনের মধ্যে একজনের (৬৫) বাড়ি বরিশাল নগরের কাজীপাড়া এলাকায় ও আরেকজনের (৬০) বাবুগঞ্জে এবং অপরজনের (৬৫) বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায়।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, দুপুরে মারা যাওয়া বরিশাল নগরের কাজীপাড়া এলাকার ওই ব্যক্তি সকাল পৌনে ১০টায় জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে ভর্তি হন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে তিনি মারা যান। বিকালে মারা যাওয়া বাবুগঞ্জের ওই ব্যক্তি সকাল পৌনে ৯টার দিকে জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার ব্যক্তি বেলা পৌনে ২টার দিকে ভর্তি হন, মারা যান পৌনে ৪টার দিকে। এ নিয়ে গত ৯ দিনে ওই ওয়ার্ডে ১১ জনের মৃত্যু হলো।

শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি, আড়াই ঘণ্টা পর মৃত্যু : করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তির দুই ঘণ্টার মধ্যে পিরোজপুর সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে গতকাল দুপুরে এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি পিরোজপুর পৌরসভার মধ্যরাস্তা মহল্লার বাসিন্দা ছিলেন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ওই ব্যক্তি (৬০) কয়েক দিন ধরে জ্বর ও সর্দি-কাশিতে ভুগছিলেন। গতকাল ১১টার দিকে তিনি হাসপাতালে নমুনা দিতে আসেন। এ সময় তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। এরপর তাকে হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। বেলা দেড়টার দিকে তিনি মারা যান। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরুল ইসলাম বলেন, মৃত্যুর পর ওই ব্যক্তির বাড়ি ও আশপাশের কয়েকটি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।

জ্বর-শ্বাসকষ্টে চবি শিক্ষকের মৃত্যু : জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষক। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে তার মৃত্যু হলেও তার স্বজনরা বলছেন, এ ধরনের সমস্যা তার আগেও ছিল বলে তারা নমুনা পরীক্ষা করাননি। গতকাল ভোরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সহযোগী অধ্যাপক সাবরিনা ইসলাম সুইটি (৫৩)। করোনা উপসর্গ নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। গতকাল ভোরে হাসপাতালের করোনা পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ডে তার মৃত্যু হয়। এই রোগী করোনা পজিটিভ ছিলেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য মরদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। মৃত বৃদ্ধার নাম নুরপুন্নি বেগম। তার বয়স ৭০ বছর। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার আটরশিয়া গ্রামের ইয়াছিন আলীর স্ত্রী।         কিশোরগঞ্জে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে শাহজাহান ভূঞা (৬৬) নামে এক ব্যবসায়ী মারা গেছেন। গতকাল সকালে কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মেডিকেল কলেজের পরিচালক ডা. সৈয়দ মনজুরুল হক বলেন, শাহজাহান ভূঞা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছিলেন। গত ২৬ মে তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তবে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো আসেনি। যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেলিনা বেগম (৩০) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার শরীর থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলেও এখনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় গত ২৯ মে সেলিনা বেগমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পাশাপাশি তার শরীরে করোনা উপসর্গও ছিল। এ কারণে তাকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখা হয়। করোনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার শরীর থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষাগারেও পাঠানো হয়। তবে ফলাফল এখনো আসেনি।

করোনা উপসর্গ নিয়ে দিনাজপুরের বিরলে গাউচিয়া বর্মণ নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর তার নমুনা সংগ্রহ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। গতকাল সকাল ৭টায় বিরল উপজেলার বিজোড়া ইউপির বিস্তইর গ্রামে নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান। করোনা উপসর্গ থাকায় তার নমুনা সংগ্রহ করেছে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। তার শ্বাসকস্টসহ করোনা উপসর্গ ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সর্বশেষ খবর