বুধবার, ৩ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

যুক্তরাষ্ট্রের ১৬৩ সিটিতে তুমুল বিক্ষোভ কারফিউ ২৫ রাজ্যে

বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়েছে অন্য দেশেও

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের ১৬৩ সিটিতে তুমুল বিক্ষোভ কারফিউ ২৫ রাজ্যে

আমেরিকায় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সপ্তম রজনীতে নতুন করে নিউইয়র্ক সিটিতে কারফিউ জারি করা হয়েছে । দুই দিন আগে থেকেই ২৫টি স্টেটের ৪৪ সিটিতে কারফিউ জারি করা হয়। ইতিমধ্যে ৫০ স্টেটের ১৬৩ সিটিতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সারা আমেরিকায় এই উত্তাল পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ অবসানে জাতীয় ঐক্যের ডাক এবং জর্জ ফ্লয়েড হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অঙ্গীকারের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উল্টো হুমকি দিলেন সামরিক শক্তি নিয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন থামিয়ে দিতে। আন্দোলনকারীদের ভাষ্য, আমেরিকার নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন প্রেসিডেন্ট। সোমবার সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউস থেকে এ বক্তব্য দেওয়ার সময় নিজেকে ‘প্রেসিডেন্ট অব ল অ্যান্ড অর্ডার’ হিসেবে অভিহিত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকারীদের বিভ্রান্ত করে জঙ্গিরূপ ধারণে লিপ্ত করছে যে অপশক্তি, তাদের দমনে প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হবে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছি। এদিকে সোমবার গভীর রাতে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে, এ যাবত চার হাজার ৮০০ বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে বিভিন্ন সিটির পুলিশ। এর মধ্যে লুটতরাজ, ভাঙচুর কিংবা অগ্নিসংযোগে লিপ্ত থাকার অভিযোগ নেই কারও বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য, রুজ গার্ডেনে স্থাপিত পোডিয়ামে ট্রাম্প যখন এ বক্তব্য দিচ্ছিলেন তার মিনিট দশেক আগে সামরিক বাহিনী, সিক্রেট সার্ভিস এবং মিলিটারি পুলিশের শত শত সদস্য হোয়াইট হাউসের আশপাশে স্লোগানরতদের ওপর হামলে পড়ে। ওরা কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও রাবার বুলেট ছুড়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করতে থাকে। এ সময় আন্দোলনকারীরা দুই হাত ওপরে উঠিয়ে বলতে থাকেন, ‘আমরা আত্মসমর্পণ করছি, তবুও গুলি করো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা, প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অনুযায়ী এই ছত্রভঙ্গ করার অভিযানে ঘোড়াসহ নিরাপত্তা রক্ষীরাও অংশ নেয়। পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ক্ষণে ক্ষণে কাঁদুনে গ্যাস ছোড়া এবং রাবার বুলেট ছোড়ার শব্দ আসতে থাকে। তার মধ্যেই ট্রাম্প তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এ বক্তব্যে সবাই প্রচ-ভাবে হতাশ হয়েছেন মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মন্তব্য, জাতির এই সংকটে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি সবাইকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানাবেন বলে প্রত্যাশা ছিল। বিশেষ করে তুমুল আন্দোলনরত রাজ্যগুলোর কয়েকজন গভর্নর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্পের বক্তব্যকে আন্দোলন উসকে দেওয়ার মতো বলে মন্তব্য করেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে নির্মমভাবে হত্যায় জড়িতদেরই শুধু নয়, এর আগে আরও যারা এমন বর্ণবৈষম্য আচরণের বলি হয়েছেন, তাদের স্মরণ করে পুলিশ বাহিনীর বিদ্যমান আইনকে সংস্কারের কথা বলতে পারতেন ট্রাম্প। তা না করে তিনি নিজের ক্ষমতার অপপ্রয়োগের স্বার্থে ১৮০৭ সালের আইন রহিত করে কাজে লাগানোর হুমকিও দিয়েছেন। এদিন দুপুরে রাজ্য গভর্নরদের সঙ্গে টেলিকনফারেন্সে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজ নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করে আন্দোলন দমনের আহ্বান জানান। ন্যাশনাল গার্ডের পাশাপাশি সামরিক বাহিনী নামানোর পরামর্শও দেন। হুমকির সুরে ট্রাম্প উল্লেখ করেন, জনসাধারণের জীবন এবং সম্পদের নিরাপত্তা বিধানে কঠোর পদক্ষেপ নিতে সম্মত না হয়, তাহলে আমি সামরিক বাহিনী মোতায়েন করব দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত করতে। স্টেট গভর্নরদের সঙ্গে টেলি কনফারেন্সে ট্রাম্প আরও নির্দেশ দেন যে, সহায়-সম্পদের ক্ষতিসাধনসহ লুটতরাজে লিপ্তদের গ্রেফতার করে দীর্ঘমেয়াদে শাস্তি দিতে হবে। জনগণের শান্তি বিনষ্টকারীরা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের দুশমন। রুজগার্ডেনে এই বক্তব্য দেওয়ার পরই নিরাপত্তা বাহিনী বেষ্টিত হয়ে পায়ে হেঁটে ট্রাম্প যান পার্শ্ববর্তী সেন্ট জোন্স এপিস্কপাল চার্চে। আগের রাতে বিক্ষোভকারীরা আগুন দিয়েছিল সেখানে। সেখানে গিয়ে বাইবেল হাতে ফটোসেশন করেন প্রেসিডেন্ট। চার্চের সামনে ফটোসেশনের সংবাদে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন চার্চটির তত্ত্বাবধায়ক বিশপ ম্যারিয়েন বাডি। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন যে, ‘প্রেসিডেন্ট সেখানে আসবেন এটি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে ছবিতে পোজ দেওয়ার ঘটনায় শঠতার পরিচয় মিলেছে।’

এদিকে, ফ্লয়েড হত্যায় গ্রেফতার হওয়া ডেরেক চোভিন (৪৪)-কে ১ জুন স্থানীয় আদালতে সোপর্দ করার কথা ছিল। সেটি পিছিয়ে ৮ জুন করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, তার বিরুদ্ধে থার্ড ডিগ্রি মার্ডার চার্জ করা হয়েছে। সেটি পরিবর্তন করে ফার্স্ট ডিগ্রিতে আনার পাশাপাশি ঘটনায় জড়িত অপর তিন কর্মকর্তা থমাস লেন, আলেক্সান্দার কিউং এবং টৌ থাওকেও গ্রেফতার করে একই মামলায় অভিযুক্ত করার জন্য শুনানির তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, মিনিয়াপলিসের পুলিশ প্রধান মেডারিয়া এরাডান্ডো ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে স্বীকার করেছেন যে, ওরা তিনজনও একইভাবে দোষী। তারা নিষ্ঠুরতম আচরণের সময় বাধা দেয়নি। অধিকন্তু সায় দিয়েছে। উল্লেখ্য, এই তিন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি বলে বিক্ষোভকারীরা জানান। এদিকে, ফ্লয়েডের ভাইয়েরা সোমবার এসেছিলেন অকুস্থলে। সেখানে বিক্ষোভকারীরা শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছেন। তখন, টেরেন্স ফ্লয়েড সবার উদ্দেশে বলেছেন যে, তারা শান্তিতে বিশ্বাসী। দাঙ্গা-হাঙ্গামা চান না। তাই আন্দোলন যেন সহিংসতায় রূপ না নেয়। এমন আহ্বানে সাড়া দিয়ে এদিন সব স্থানেই যতটা সম্ভব শান্তির সুবাতাশ বইয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তবুও অনেক সিটি প্রশাসনই বিক্ষোভে বহু মানুষের সমাগম দেখে কারফিউ অব্যাহত রেখেছেন মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত। আরও জানা গেছে, ফ্লয়েড হত্যা মামলা পরিচালনার দায়িত্ব মিনেসোটা স্টেট অ্যাটর্নি জেনারেল কিথ এলিসনকে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ছিল হেনেপিন কাউন্টি অ্যাটর্নি মাইক ফ্রিম্যানের ওপর। ফ্রিম্যান শ্বেতাঙ্গ হওয়ায় মামলার বিচারকার্য নিয়ে অনেকের সন্দেহ তৈরি হতে পারে আশঙ্কায় স্টেট গভর্নর কিথ এলিসনকে দায়িত্বটি দিয়েছেন। কারণ, কিথ এলিসন হলেন কৃষ্ণাঙ্গ। সোমবার গভীর রাতে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে, এ যাবত ৪ হাজার ৮০০ বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে বিভিন্ন সিটির পুলিশ। এর মধ্যে অবশ্য লুটতরাজ, ভাঙচুর কিংবা অগ্নিসংযোগে লিপ্ত থাকার অভিযোগ নেই কারও বিরুদ্ধে। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্দেশ দিয়েছেন যে, গ্রেফতারকৃতরা যেন দীর্ঘ মেয়াদে কারাগারে থাকে-এমন মামলা দিতে হবে। আরও জানা গেছে যে, নিউইয়র্কে কারফিউ বহালের পরও হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে ব্রুকলিন ব্রিজ অতিক্রম করছেন। এর দুই ঘণ্টা আগে বড় বড় শপিং মলে হামলা, ভাঙচুরের পর মালামাল লুটের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ট্রাম্প টাওয়ারের নিকটে কয়েকটি স্টোরেও ভাঙচুর ও লুটের ঘটনা টিভিতে সরাসরি প্রচারিত হয়েছে।

ফিলাডেলফিয়ায় লুটতরাজের ভিকটিম বাংলাদেশিরাও : মিনিয়াপলিস সিটির কয়েকশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের পর সব মালামাল লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে এক বাংলাদেশির দুটি সোনার দোকানসহ মোট ৩৫টি দোকান লুটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রবিবার রাতে কারফিউ চলাকালে দোকানের তালা ভেঙে সবকিছু লুটে নেওয়া হয়েছে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ খবর