বৃহস্পতিবার, ৪ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

মানব পাচার চক্রে ৩৮ জন

গ্রেফতার ৭, লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে এখনো ১৯ বাংলাদেশি

মাহবুব মমতাজী

লিবিয়ায় বাংলাদেশি পাচারকারী চক্রের ৩৮ জনকে শনাক্ত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা গত বছরের জানুয়ারি থেকে মিথ্যা প্রলোভনের শিকার গুলিতে নিহত ২৬ জনসহ আরও অনেককে ধাপে ধাপে পাচার করে আসছিল।

গত ২ জুন রাজধানীর পল্টন থানায় পাচারকারী চক্রের এই ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত ৩০-৩৫ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে সিআইডির মানব পাচার টিম। এই মামলার পরই গ্রেফতার অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপরই কিশোরগঞ্জ সিলেট ও বরগুনা থেকে সাতজনকে আটক করে র‌্যাব। মঙ্গলবার রাতে কিশোরগঞ্জ ভৈরবের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিন মানব পাচারকারীকে আটক করে র‌্যাব। তারা হলেন শম্ভুপুর গ্রামের হেলাল মিয়া ওরফে হেলু, লক্ষ্মীপুর গ্রামের খবির উদ্দিন ও তাতারকান্দির শহিদ মিয়া এবং মুন্নি আক্তার রূপসী। এর আগে সোমবার বিকালে সিলেট বিশ্বনাথে কাঠলীপাড়া বাড়ি থেকে রফিক আহমদ নামে আরেক পাচারকারীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এছাড়া সিরাজগঞ্জ র‌্যাব-১২-এর একটি চৌকস দল গত মঙ্গলবার বরগুনা জেলার পাথরঘাটা এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুজনকে আটক করে। তারা হলেন পাথরঘাটা থানার খাসতবক গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে সজল হোসনে (২৩) ও একই থানার নাচনাপাড়া গ্রামের ইউসুফ গড়ামীর ছেলে ইদ্রিস আলী।

সিআইডির শনাক্ত হওয়া পাচারকারী চক্রের ৩৮ জন হলেন লিবিয়ায় অবস্থানরত কিশোরগঞ্জ ভৈরবের তানজিলুর ওরফে তানজিদ, একই এলাকার বাচ্চু মিলিটারী, তানজিদের ভাতিজা নাজমুল, ভৈরবের মৌটুপী এলাকার জোবর আলী, লিবিয়া অবস্থানরত ভৈরবের লক্ষ্মীপুরের জাফর, একই এলাকার হাজী শহিদ মিয়া, মুন্নি আক্তার রূপসী, লিবিয়ায় অবস্থানরত ভৈরবের শম্ভুপুরের স্বপন, একই এলাকার হেলাল মিয়া, ভৈরব শিমুলকান্দির মিন্টু মিয়া, তাতারকান্দি এলাকার মো. খবির উদ্দিন, পুরান পল্টনের স্কাইভিউ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সির প্রোপাইটর, কুষ্টিয়া সদরের হাজী কামাল, একই এলাকার আলী হোসেন, শরিয়তপুর পালং মডেল থানার সাদ্দাম, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের কামাল হোসেন, মাদারীপুর রাজৈরের রাশিদা বেগম, একই এলাকার চার ভাই নুর হোসেন শেখ, আকবর হোসেন শেখ, ইমাম হোসেন শেখ ও আমির শেখ। এ এলাকার বুলু বেগম, জাহিদুল শেখ, জাকির মাতুব্বর, আমির হোসেন, কুদ্দুস বয়াতী, নাসির, সজীব মিয়া, রেজাউল বয়াতী, ও জুলহাস সরদারও জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া মাদারীপুর সদরের দিনা বেগম, নজরুল মোল্যা, ঢাকার শাহাদাত হোসেন, গোপালগঞ্জ মোকসুদপুরের লিয়াকত শেখ ওরফে লেকু শেখ, একই এলাকার আবদুর রব মোড়ল। কাশিয়ানির দুই ভাই শেখ মো. মাহবুবুর রহমান ও শেখ সাহিদুর রহমান। তাদের শহীদ তাজ উদ্দিন সরণিতে নাভিরা লিমিটেড এবং হাতিরঝিলে ফ্লাইওভার ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস নামে দুটি প্রতিষ্ঠান আছে। রাজধানীর বাংলামোটরের একটি ট্রাভেলস এজেন্সির মালিক লালনকেও শনাক্ত করা হয়েছে।

এদের দ্বারা যারা পাচারের শিকার হয়েছেন তারা হলেন মাদারীপুর রাজৈরের জুয়েল, মো. আলী, সম্রাট খালাসী, মানিক, টেকেরহাটের আসাদুল, আয়নাল মোল্লা, জুয়েল-২, মনির, রাজৈর ইশবপুরের মনির, সজীব, মাদারীপুরের ফিরোজ, দুধখালীর শামীম, ঢাকার আরফান, কিশোরগঞ্জ হোসেনপুরের রহিম, ভৈরবের রাজন, জানু মিয়া, সৌরভ আহাম্মেদ ওরফে সোহাগ, সজল মিয়া, শাকিল, আকাশ, সোহাগ, মো. আলী, গোপালগঞ্জের সুজন, ওমর শেখ, কামরুল, যশোরের রাকিবুল, মাগুরার লাল চান্দ, মাদারীপুরের জাকির হোসেন, ফিরোজ বেপারী, সাজিদ, টাঙ্গাইলের তরিকুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গার বকুল হোসাইন এবং বাপ্পীসহ ৩৮ জন।

সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানতে পারে, এরা স্থানীয় লিবিয়ান পাচারকারীদের সহায়তায় বাংলাদেশি ও সুদানিদের আটকে রাখে। সেখানে তাদের নির্যাতনের ছবি অনলাইনে স্বজনদের কাজে পাঠিয়ে ৮-১০ লাখ টাকা দাবি করা হতো। দাবি করা টাকা না পাঠালে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হতো। এক পর্যায়ে আত্মরক্ষার জন্য সুদানি নাগরিকরা স্থানীয় এক পাচারকারীকে হত্যা করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই পাচারকারীর সহযোগীরা গত ২৮ মে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। এতে ঘটনাস্থলে ২৬ বাংলাদেশিসহ সুদানি নিহত হন।

দুই আসামির রিমান্ড : লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে করা মামলার চার দিন করে  দুই আসামিকে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন এ আদেশ দেন। আসামিরা হলেন ঢাকার শহীদ তাজউদ্দিন সরণির ট্র্যাভেল এজেন্সি নাভীরা লিমিটেডের মালিক শেখ মো. মাহবুবুর রহমান (৪৯) ও হাতিরঝিলের ফ্লাইওভার ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস লিমিটেডের মালিক শেখ সাহিদুর রহমান (৪০)। আসমিরা গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের আবদুল মোতালেবের ছেলে। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মিজানুর রহমান আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকার মুখ্য মহানগর মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। এসময় আসমিদের পক্ষে জামিনের আবেদন করেন আইনজীরা। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন তাদের চার দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন।

লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে আটক আরও ১৯ বাংলাদেশি : লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের হাতে আরও ১৯ বাংলাদেশি আটক রয়েছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, লিবিয়ায় আরও ১৯ জন বাংলাদেশি অন্য একটি মাজরাতে আটক রয়েছেন। মুক্তিপণের জন্য তাদের ওপরও নির্মম অত্যাচার চলছে। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। মানব পাচারকারীদের হাতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনার দেশটির অন্যতম হোতা নিহত হয়েছে বলে লিবিয়ার গণমাধ্যমে জেনেছি। গতকাল গণমাধ্যমের সঙ্গে আলোচনা এসব তথ্য জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাবস্থা চলা এ দেশটি এখন মানব পাচারের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। হয়তো আরও অনেক বাংলাদেশি সেখানে আটক রয়েছেন। তবে আমরা এ ১৯ জনের কথা জানতে পেরেছি। সেখানকার একজন বাংলাদেশি আমাদের দূতাবাসকে জানিয়েছে, ত্রিপলী থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরে একটি মাজরাতে এ ১৯ বাংলাদেশিকে মানবপাচারকারীরা মুক্তিপণের জন্য আটকে রেখে নির্যাতন চালাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নিশ্চয় পাচারকারীরা আটক বাংলাদেশিদের পরিবারের সঙ্গে টাকার জন্য দেন দরবার করছে। এসব পরিবারের উচিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করা। তা না হলে কারা তাদের কাছে টাকা চাইছে কারা এসব মানবপাচারে জড়িত সেসব কিছুই আমরা জানতে পারব না। এসব বাংলাদেশির পরিবারকে তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনাদের সঙ্গে পাচারকারীদের যেসব দালাল যোগাযোগ করছে তাদের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিন। মন্ত্রী বলেন, এর আগে যে ৩৮ জন আটক ছিল তাদের পরিবারের কাছেও সেখানকার মানব পাচারকারীদের দালালরা ফোন করে মুক্তিপণ আদায় করত। তারা যদি সেসব বিষয় জানাত তাহলে অকালে এত প্রাণ যেত না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর