মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

ঝুলছে মানব পাচারের মামলা

বিচার যেন শেষই হয় না, ছয় হাজার মামলার মাত্র চার শতাংশ নিষ্পত্তি

আরাফাত মুন্না ও মাহবুব মমতাজী

ঝুলছে মানব পাচারের মামলা

কক্সবাজারের রামু উপজেলার এক নারীকে নেপালে ভালো চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখায় মানব পাচারকারীরা। ২০১৪ সালের আগস্টে তাদের খপ্পরে পড়ে ওই নারীর ঠাঁই হয় খুলনার একটি যৌনপল্লীতে। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। পাঁচ মাস পর ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিন মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে রামু থানায় একটি মামলা করে মেয়ের পরিবার। ওই বছরের অক্টোবরে তিনজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ। এখন পর্যন্ত বিচার শুরু হওয়া তো দূরের কথা, কোনো আসামি কেউ ধরাই পড়েনি। শুধু এ মামলাটিই নয়, মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা থাকলেও বছরের পর বছর ঝুলে থাকে এসব মামলা। ২০১২ সালে আইন হওয়ার পর  এ পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার মামলা দায়ের হলেও নিষ্পত্তি হয়েছে চার শতাংশেরও কম। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার পেছনে সাক্ষী হাজির না হওয়াকে দায়ী করছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। আইনজ্ঞরা বলেন, এ আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে, এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও পুলিশকে আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে বলেও মত তাদের। ২০১২ সালের ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে’ সংঘবদ্ধভাবে মানবপাচারের জন্য মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদন্ড এবং অন্যূন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান আছে। এ আইনের ২১(১) ধারায় এসব মামলার বিচারে আলাদা ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের কথা বলা আছে। আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার বিচার শেষের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। এ ছাড়া ১৯(৬) ধারায় আছে, এসব মামলা তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল থাকবে। কিন্তু আইন হওয়ার আট বছর পরও দেখা মেলেনি ট্রাইব্যুনাল বা মনিটরিং সেলের। বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এসব মামলার বিচার হচ্ছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য বলছে, আইনটি হওয়ার পর গত প্রায় আট বছরে দেশে পাঁচ হাজার ৭১৬টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৪৭টি অর্থাৎ মাত্র চার শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এদিকে সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বিচারাধীন মানবপাচার মামলার সংখ্যা চার হাজার ৬০১টি। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে ১৯৭টি মামলা।

জানতে চাইলে ঢাকার আদালতে মানবপাচার পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ বলেন, বিচারক সব সময় চেষ্টা করেন মামলাগুলো দ্রুত শেষ করার। কিন্তু আসামিপক্ষ বিভিন্ন অজুহাতে বার বার সময় নেয়। আবার অধিকাংশ সময়ই সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এজন্য মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে।

জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এ আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে যারা মানবপাচার করছে তাদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। এটি করা গেলে কমে আসবে মানবপাচার। দ্রুত আইন অনুযায়ী পৃথক ট্রাইব্যুনাল স্থাপনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, আসামিদের অহেতুক সময়ক্ষেপণ ঠেকাতে তৎপর হতে হবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের।

সিআইডির ডিআইজি (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স) ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মানবপাচার প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী এসব মামলার বিচারের আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা আছে। এখনো পযন্ত ট্রাইব্যুনাল না হওয়াতে সেসব মামলার বিচার নারী ও শিশু নিযাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হচ্ছে, যেকারণে একটু দীর্ঘসূত্রতা। তবে মামলার বিচার দ্রুত সম্পন্ন হলে মানবপাচারের ঘটনা অনেকাংশই কমে আসবে।

গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদা শহরে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মারাত্মক আহত হন আরও ১১ জন। শুধু এ ঘটনায় নয়, বিদেশে ভাগ্য ফেরাতে গিয়ে পাচারকারীদের হাতে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছেন হাজারো মানুষ। হচ্ছেন নির্মম নির্যাতনের শিকার। এসব ঘটনায় বিচার চেয়ে নিহতের স্বজনরা বিভিন্ন সময় মামলা করলেও বিচার পেতে তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে বছরের পর পর। তাই লিবিয়ায় প্রাণ হারানো বাংলাদেশি পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে যাতে এমন না হয়, তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

জানা যায়, ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন প্রণয়নের পর প্রথম মামলাটি হয় একই বছরের ৭ এপ্রিল নওগাঁ জেলায়। মিসরে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা বাবু নামের একজন মামলাটি করেন। মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আসামিরা গ্রেফতার হন, পরে আবার জামিনে বেরিয়ে যান। দীর্ঘ সাত বছরেও এগোয়নি মামলার বিচারকাজ।

সর্বশেষ খবর