মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

কুয়েতে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এমপি পাপুলকে আটক রাখার আবেদন

অভিযোগ গুরুতর বলছেন দেশটির আইনজীবী কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক ও লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

কুয়েতে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এমপি পাপুলকে আটক রাখার আবেদন

লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আটক রাখার আবেদন জানিয়েছে কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউটর। গতকাল কুয়েতের অন্যতম শীর্ষ অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আল রাই এ খবর দিয়েছে। আল রাই এর খবরে বলা হয়েছে, আবেদনে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ গুরুতর উল্লেখ করা হয়। তবে কুয়েতের সিআইডির হাতে আটক পাপুলের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি সে দেশের সরকার। ঢাকা ও কুয়েতের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, একজন এমপি আটক হওয়ার খবরে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। বিভিন্ন মাধ্যমে পাপুলের কর্মকান্ড সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।  দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় প্রকাশিত বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখছে সরকার। সেই সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছে  কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাসকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, কুয়েত নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছেন যে কী কারণে তাকে নিয়ে গেছে। কিন্তু কুয়েত সরকার এ ব্যাপারে কিছুই জানায়নি। তিনি বলেন, এমপি শহীদ ইসলাম ওখানে ব্যবসা করেন। ওনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। ব্যবসায়িক কোনো কারণে হয়তো এসব হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো বিস্তারিত কিছু জানি না।

অন্যদিকে, মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতে আটক হওয়ার খবরের পর এমপি শহীদ ইসলাম পাপুলকে নিয়ে লক্ষ্মীপুর সর্বত্রে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এই এমপিকে ঘিরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালের শুরুর দিকে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে আসেন কুয়েত প্রবাসী কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। তিনি রায়পুরের সন্তান হিসেবে নিজের এলাকার উন্নয়নে অবদান রাখার ইচ্ছা পোষণ করে মাঠে নামেন। তিনি তখন রায়পুর উপজেলাকে জেলা করার ঘোষণাও দেন। সরকার ১০০ কোটি টাকা উন্নয়ন কাজে বরাদ্দ দিলে তার নিজ থেকে আরও ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও জাকের পার্টির নেতা জামশেদ কবীর বাকি বিল্লাহর হাত ধরে বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা দান-অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেকে ধনকুবের হিসেবে প্রকাশ করেন পাপুল। তৎকালীন সময়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন ধনাঢ্য ওই ব্যক্তি। নিজেকে কুয়েতে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীসহ হাজার কোটি টাকার মালিকও দাবি করেন। ওই সভায় মানবসেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার ইচ্ছা পোষণ করে নির্বাচন কিংবা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চান না বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি। পরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান তিনি। মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এরপর মহাজোট প্রার্থী মোহাম্মদ নোমানের রহস্যজনক আত্মগোপনের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এমপি নির্বাচিত হন পাপুল। নির্বাচনের আগে তিনি সংসদীয় আসনের ১৯টি ইউনিয়নের প্রতিটি ইউনিয়নে উন্নয়ন কাজে  তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে এক কোটি টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কিন্তু নির্বাচনের পর এ এমপি এলাকায় অনিয়মিত ও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের ধারেকাছেও নেই বলে জনশ্রুতি আছে। স্বতন্ত্র কোটা থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলামও এমপি নির্বাচিত হন। এমপি দম্পতির কাছে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ছিল অনেক। বর্তমানে মানব পাচারের অভিযোগে পাপুলের গ্রেফতার হওয়ার খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে বলে মতপ্রকাশ করেন লক্ষ্মীপুর ও রায়পুরের মানুষ। এ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে তাদের মধ্যে।

পাপুলের নির্বাচনী এলাকার দক্ষিণ হামছাদি, টুমচর, শাকচরসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সভা-সমাবেশে দেওয়া উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেকে বলছেন, এমপির দেখা পাওয়া কঠিন। তিনি বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করেন। দেশে এলেও ফোনও ধরেন না। 

গতকাল দুপুরে এমপির গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে তার বাড়িতে তালা ঝুলছে। আশপাশের কেউ মুখ খুলছে না। বাড়ির পাশে কর্মরত একাধিক শ্রমিক জানান, এমপির কাছ থেকে এ পর্যন্ত কোনো ধরনের সহায়তা পাননি তারা। করোনা পরিস্থিতিতেও এমপি কোনো সহায়তা করেননি বলে শ্রমিকরা জানান। এমপির প্রতিবেশী বয়োবৃদ্ধ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, পাপুল আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। অতীতে কিছুই ছিল না তাদের। বর্তমানে এত টাকা কোথায় পেলেন। তিনি জাসদ করতেন। তারপর চলে যান কুয়েতে। ছিলেন জামায়াত নেতার ম্যানেজার। এখন নাকি হয়ে গেছেন কোম্পানি। পাপুলের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করে বের করে তার শাস্তির দাবি জানান তারা।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি শামছুদ্দিন বাবুল জানান, নির্বাচিত হয়ে এমপি পাপুল এলাকায় অবস্থান না করায় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব পড়ছে। তার ডিও লেটার না পেয়ে লক্ষ্মীপুর সদরের আংশিক ও রায়পুরের ৬৫টি বিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। এতে করে বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ শিক্ষার ওপর প্রভাব পড়ছে। লক্ষ্মীপুর প্রেস ক্লাব সভাপতি হোসাইন আহমদ হেলাল জানান, লক্ষ্মীপুর-২ আসনটি নদীবেষ্টিত হওয়ায় এখানে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস বেশি। করোনা মহামারীসহ এলাকার সার্বিক উন্নয়নে এ আসনটিতে এমপি শূন্যতা বিরাজ করছে। এতে এমপির কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ।

সর্বশেষ খবর